Category: মতামত

Get updates on Bengali News analysis discussion, opinion editorial from the Madhyom news portal madhyom.com, West Bengal leading news portal Madhyom.com

  • Mohan Bhagwat: মোহন ভাগবতের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের আলোচনা কতটা তাৎপর্যের?

    Mohan Bhagwat: মোহন ভাগবতের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের আলোচনা কতটা তাৎপর্যের?

    শাহাবুদ্দিন ইয়াকুব কুরেশি: যেই না মুসলিম সম্প্রদায়ের পাঁচজন সদস্য আরএসএস (RSS) প্রধান মোহন ভাগবতের (Mohan Bhagwat) সঙ্গে ২২ অগাস্ট সাক্ষাৎ করেছেন, তার পর থেকে নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। যে পাঁচজন ভাগবতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন তাঁরা হলেন দিল্লির প্রাক্তন লেফটেনেন্ট গভর্নর নাজীব জং, সাংবাদিক শাহিদ সিদ্দিকি, হোটেলিয়ার সঈদ শেরভানি, লেফটেনেন্ট জেনারেল জামিরউদ্দিন শাহ এবং এই লেখক। 

    আমাদের এই পাঁচজনের এহেন উদ্যোগের ব্যাখ্যা আমি দেব। আমরা এই পাঁচজন— আমাদের মধ্যে একটা উদ্বেগ রয়েছে। আর সেই উদ্বেগের কারণ মুসলিম সম্প্রদায়ের নিরাপত্তাহীনতা। একইসঙ্গে এই বিশ্বাস যে আলোচনার মাধ্যমেই একমাত্র সমস্যার সমাধান সম্ভব। যেই না ভাগবতের সঙ্গে বৈঠকের খবরটি ছড়িয়ে পড়েছে, আমরা অসংখ্য মেসেজ পেয়েছি। এঁদের মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন অ-মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও। 

    আমরা অনেক সমালোচনা মূলক মন্তব্যও পেয়েছি। যেমন, প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে, মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার কে আমাদের দিয়েছে। কেউ কেউ আবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অন্য একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছি ভেবে। এতে আমাদের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হতে পারে। কেউ কেউ আবার ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি ভেবে সতর্ক করে দিয়েছেন। তবে, কথপোকথনই যে একমাত্র পথ, তা নিয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেননি। এঁদের প্রত্যেকের কণ্ঠেই শোনা গিয়েছে একই সুর। তা হল, কথপোকথনই একমাত্র এগিয়ে চলার পথ।

    আমাদের একাধিকবার প্রশ্ন করা হয়েছে, যে এই কথোপকথন চালিয়ে কী হাসিল করলাম। এই বৈঠক করতে কে উৎসাহ জুগিয়েছিল? ইদানিং যেসব চলছে, তা নিয়ে আমাদের উদ্বেগ, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন যে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন নানা ঘটনার জেরে বিশেষত উন্মত্ত হিন্দুত্ববাদীদের হাতে নিরীহদের গণধোলাইয়ের শিকার হওয়া, এবং সমাজের প্রতিক্ষেত্রে এই সম্প্রদায়ের মানুষজনে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হওয়া। 

    বৈঠকটি কেমন সম্পন্ন হয়েছিল? প্রথমত, আরএসএস প্রধানের সারল্য ও বিনয়ীভাব দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম। তারপর তাঁর সময়ানুবর্তিতা। তিনি ঘড়ি ধরে ১০টার সময় বৈঠকে এসেছিলেন। তাঁর ধৈর্যও ছিল। গভীর মনযোগ দিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে তিনি আমাদের সমস্ত কথা শুনেছেন। এই সময় তিনি আমাদের একবারের জন্যও থামাননি। ভাগবতের সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহযোগী কৃষ্ণণ গোপাল। অবশ্যই আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে ভাগবত একটি কর্তৃত্বের জায়গা থেকে কথা বলছিলেন। 

    ভাগবতের আচার আচরণ খারাপ লাগেনি। তাঁর আচরণে এমন কিছু ছিল না, যা অস্বস্তিকর বলে মনে হয়। তাঁর মন্তব্যে তিনি তিনটি জিনিসের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। হিন্দুত্ব একটি পূর্ণতার ধারণা, যাতে সব সম্প্রদায়ের জন্য সমান জায়গা রয়েছে। তিনি আরও বলেছিলেন, দেশ এগোতে পারে কেবলমাত্র তখন, যখন বিভিন্ন সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ হয়। একটি তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্যে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ভারতীয় সংবিধান পবিত্র এবং গোটা দেশকে তা মেনে চলতে হবে। আরএসএস সংবিধান পরিত্যাগ করতে চাইছে এবং মুসলমানদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে, এই ভয় দূর করতে চেয়েছিলেন তিনি। 

    তারপর ভাগবত বলেছিলেন, হিন্দুরা দুটি বিষয়ে খুবই সংবেদনশীল। প্রথমটি হল, গরু। আমরা বলেছিলাম মুসলিমরা এটা ভাল মতোই বোঝেন। ভারতের অধিকাংশ জায়গায় গোহত্যা বন্ধ হয়েছে। আইনভঙ্গকারীদের ইতিমধ্যেই আইন মেনে শাস্তিও দেওয়া হয়েছে। যে সব রাজ্যে গোহত্যা নিষিদ্ধ হয়নি, সেখানে মুসলমানদের স্বেচ্ছায় গোমাংস পরিত্যাগ করা উচিত। এটা যদি সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, তবে এটা করা উচিত। 

    আর একটি সংবেদনশীল বিষয়ের উল্লেখ করেন তিনি। সেটা হল হিন্দুদের (Hindu) ‘কাফের’ বলা হয়। আমরা বলেছিলাম আরবি শব্দ কাফের-এর আক্ষরিক অর্থ হল অ-বিশ্বাসী। যদি এটা অপমানজনক হয়, তবে মুসলমানদের এটা পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া উচিত। খুব সহজ। খুব সম্ভব। কোরানে বলা হয়েছে, আল্লাহ হলেন রাব্বুল আলামিন, রাব্বুল মুসলিমীন নন। বিশ্বজগতের ঈশ্বর, কেবল মুসলমানদের নন। কোরান বলে, তোমার কাছে তোমার ধর্ম, আমার কাছে আমার।

    আমরা তাঁকে বলেছিলাম, একই ভাবে প্রতিটি মুসলমানের কাছে জেহাদি এবং পাকিস্তানি শব্দদুটিও অপমানজনক। এগুলি এখনই বন্ধ হওয়া উচিত বলে তিনি সম্মত হয়েছিলেন। আমরা তাঁকে আরও আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন বলে জানিয়েছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁর কোনও সহযোগীর নাম বলুন যাঁর সঙ্গে আমরা আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে পারি। তিনি চারজনের নাম বলেছিলেন। প্রয়োজনে তাঁকেও জানাতে বলেছিলেন। আমি আমার সহকর্মীদের সম্মতিতে ভাগবতকে আমার বই ‘দ্য পপুলেশন মিথ: ইসলাম, ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যান্ড পলিটিক্স অফ ইন্ডিয়া’ উপহার দিই। 

    বৈঠকে আমি চারটি বিষয়ের উল্লেখ করেছি। এক, মুসলিমদের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সব চেয়ে বেশি বলে যা বলা হচ্ছে, তা অতিরঞ্জিত। তিরিশ বছর আগে হিন্দু এবং মুসলমানের জন্মহারের অনুপাত ছিল ১:১। এখন তা নেমে হয়েছে ০.৩, যেহেতু মুসলমানরা এখন হিন্দুদের চেয়েও দ্রুত ফ্যামিলি প্ল্যানিং করছে। দুই, সাধারণ ধারণার বিপরীতে গিয়ে বলি, মুসলিমদের মধ্যে বহু বিবাহের ঘটনা খুবই কম অন্তত ভারত সরকারের রিপোর্ট এবং সেনসাস অনুযায়ী। তিন, বহুল প্রচলিত বহুবিবাহ ভারতে সম্ভবও নয়। নারী-পুরুষের অনুপাতের কারণেই তা সম্ভব নয়। প্রতি হাজার পুরুষে মহিলার সংখ্যা ৯৪০ জন। যার অর্থ ৬০ জন পুরুষ বউই পাবেন না। এটা শুনে ভাগবত প্রাণখোলা হাসি হেসেছেন। চার, অঙ্কের মডেলেই দেখা যাচ্ছে গত হাজার বছরে মুসলিমরা হিন্দুদের ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। আমার অনুরোধে এই মডেল তৈরি করেছিলেন অঙ্কের অধ্যাপক দীনেশ সিং এবং অজয় কুমার। 

    এই বৈঠক নিয়ে মিডিয়া অক্সিজেন পেয়েছে। তাই খবর করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। প্রতিক্রিয়া? দারুণভাবে পজিটিভ। সংরক্ষণ? আরএসএস বদলাবে না। হতে পারে, নাও হতে পারে। সমালোচনা: আমরা তাদের বৈধতা দিচ্ছি। যদিও, বৈধতাদানের প্রয়োজন ওদের নেই। তারা ইতিমধ্যেই পৃথিবীতে বৃহত্তম ও সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন হয়ে উঠেছে। আর আমরা? এক ঝাঁক অবসরপ্রাপ্ত লোক যাঁরা কর্মজীবনে সফল ছিলাম এবং এখন সমাজ এবং দেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন। 

    আমরা কি গোটা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছি? আমাদের কেউই নির্বাচিত কিংবা মনোনীত নন। কিন্তু আমরাও এই সম্প্রাদায়ের অংশ। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পর্যবেক্ষণের জায়গা রয়েছে। এটা আমাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ। আমরা কি এলিটিস্ট? সম্ভবত। কিন্তু আমাদের অভিযোগকারী যাঁরা, তাঁরা রাজপ্রাসাদে বসবাস করেন, যাঁদের বাড়িঘর আমাদের বাড়িঘরের চেয়ে ১০-১৫ গুণ বড়। 
    আমরা অশিক্ষিত নই। আমরা বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন: গণধোলাই, গণহত্যা, ধর্ষণ, অর্থনৈতিক বয়কট, ভোটাধিকার নিয়ে প্রশ্ন, বাড়িঘর এবং চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য। আমাদের দ্বন্দ্ব: আমরা মিডিয়ার কাছে কতটা এক্সপোজ করব? আমরা প্রথমে তাদের কাছে যেতে চাইনি। কিন্তু যখন তারা অ্যাপ্রোচ করেছিল, তখন আর আমরা তাদের কাছ থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখিনি। 

    সর্বোপরি, আমরা এক মাস ধরে মিডিয়ার কাছে বিষয়টি লুকিয়ে রেখেছিলাম। যখন আমরা ডজন ডজন বন্ধুদের কাছে মুক্তভাবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলাম। এটা সেই নিন্দুকদের জবাব দেবে, যারা বলেছিল আমরা প্রচার পাওয়ার জন্য এটা করেছি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এই কথোপকথন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। আমাদের হারানোর কিছু নেই। কিন্তু লাভ করার জন্য সব কিছু আছে। আমরা আমাদের ফিলিংসের কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও বলেছি। আমরা আশা করি, তিনি আমাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলবেন।

    লেখক দেশের প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। প্রবন্ধটি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।

  • RSS: আরএসএসের কাছে গুরুপূর্ণিমার মাহাত্ম্য কতটা, জানেন কি?  

    RSS: আরএসএসের কাছে গুরুপূর্ণিমার মাহাত্ম্য কতটা, জানেন কি?  

     

    অরুণ আনন্দ

     

    আজ গুরুপূর্ণিমা (Guru Purnima)। গুরুর প্রতি শিষ্যের (Disciple) শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের দিন। দিনটি ব্যাসদেবের জন্মদিনও। মহর্ষি ব্যাস চতুর্বেদ সম্পাদনা ছাড়াও রচনা করেছিলেন ১৮টি পুরাণ। তাই দিনটি ব্যাস পূর্ণিমা নামেও খ্যাত। শ্রদ্ধার সঙ্গে দিনটি পালন করে আরএসএসও (RSS)। এই দিন থেকে শুরু হয় আরএসএসের গুরুদক্ষিণা (Gurudakshina) দিবস।

    তবে আরএসএসের কাছে গুরুদক্ষিণা দিবস কোনও একটি দিন নয়। প্রায় একমাস ধরে চলতে থাকে অনুশীলন। গোটা দেশে আরএসএসের ৬০ হাজার শাখায় পালিত হয় গুরুদক্ষিণার অনুষ্ঠান। ফি বছর আরএসএস ছটি অনুষ্ঠান পালন করে। তারই একটি হল গুরুপূজা। বাকি পাঁচটি হল বিজয়াদশমী, মকর সংক্রান্তি, বর্ষা প্রতিপদ, হিন্দু সম্রাজ্য দিবস এবং রাখিবন্ধন। গুরুপূর্ণিমার দিনেই শুরু হয় আরএসএসের গুরুদক্ষিণা কর্মসূচির। কর্মসূচি পালিত হয় প্রায় এক মাস ধরে। মূলত দুটি কারণে পালিত হয় এই কর্মসূচি। একটি কারণ হল, ভারতীয় সংস্কৃতি মেনে গুরু-শিষ্যের চিরন্তন সম্পর্ক বজায় রাখা। আর দ্বিতীয় কারণ হল, নিজস্ব সম্পদে বলীয়ান হয়ে ওঠা, যাতে কখনওই অন্য কারও ওপর নির্ভর করতে না হয়।

    সুপ্রাচীন কালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম পর্বে গুরুগৃহে থেকে শিক্ষালাভ করতেন শিষ্যরা। শিক্ষাপর্ব শেষ হলে দিতে হত গুরুদক্ষিণা। গুরুর প্রতি শিষ্য যে কৃতজ্ঞ, তার প্রকাশক এই গুরুদক্ষিণা। অতীতের সেই পরাম্পরা মেনে আজও গুরুদক্ষিণার অনুষ্ঠান উদযাপন করে আরএসএস। একটি হলঘরে পালিত হয় অনুষ্ঠানটি। সচরাচর সকালেই হয় অনুষ্ঠান। এদিন সবাই সাদা পোশাক পরে যোগ দেন অনুষ্ঠানে। ভারতীয় ঐতিহ্য মেনে স্বয়ংসেবকরা পরে ধুতি কুর্তা কিংবা কুর্তা পাজামা। ওই হলঘরেই তোলা হয় আরএসএসের গেরুয়া পতাকা। জ্বালানো হয় মাটির প্রদীপ, ধূপ। আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার এবং দ্বিতীয় সরসংঘচালক মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকর। আরএসএসের মধ্যে গুরুজি নামে পরিচিত এই গোলওয়ালকর।

    আরও পড়ুন : ২০২৪ সালের মধ্যে ১ লক্ষ শাখা ! শতবর্ষ উদযাপনের আগে পরিকল্পনা আরএসএস-এর

    গুরুদক্ষিণা অনুষ্ঠানের শুরুতে গুরুর উদ্দেশে নিবেদিত কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারিত হয় সমবেত কণ্ঠে। এর পরেই স্বয়ংসেবকরা গান দেশপ্রেমের গান। তার পরে এক একজন গিয়ে গৈরিক নিশানের পদপ্রান্তে অর্পণ করে পুষ্পার্ঘ্য। প্রণাম জানিয়ে ফিরে যান নিজের জায়গায়।পরে সাদা খামে মোড়া দক্ষিণা দান করেন স্বয়ংসেবকরা। যেহেতু দান মোড়া থাকে খামে, তাই কেউই জানেন না, ঠিক কত দক্ষিণা কে দিলেন। খাম রেখে আরও একবার প্রণাম সেরে ফের ফিরে যান নিজের জায়গায়।

    কেবল স্বয়ংসেবকরা নন, গুরুদক্ষিণার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। অধ্যাপক, চিকিৎসক, সশস্ত্র বাহিনীর কোনও প্রাক্তন আধিকারিক কিংবা সমাজের কোনও গণ্যমান্য ব্যক্তি।এভাবেই ধীরে ধীরে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা যুক্ত হয়ে পড়েন আরএসএসের সঙ্গে। সব শেষে হয় আরএসএসের প্রার্থনা। অনুষ্ঠান পর্ব শেষ হলে পরে খাম খুলে হিসেব নিকেশ করা হয় গুরুদক্ষিণা বাবদ প্রাপ্য অর্থ।

    আরও পড়ুন : উদয়পুরের মতো নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদ করা উচিত মুসলিমদেরও, জানাল আরএসএস

    আরএসএসের কাছে গুরুদক্ষিণার তাৎপর্য অনেক। এর মধ্যে গুরু-শিষ্যের চিরন্তন সম্পর্কের পরম্পরা বজায় রাখাও যেমন একটি, তেমনি শিষ্যদের থেকে সংগ্রহ করা হয় সংঘ চালনার অর্থ। সংঘে গৈরিক পতাকা চির উড্ডীন রাখতে যা প্রয়োজন। সর্বোপরি, সংঘের পতাকা যে সবার ওপরে, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাও বুঝিয়ে দেওয়া হয় সংঘ-সদস্যদের।

    শুধু তাই নয়, গুরুদক্ষিণা দিবস পালনের আরও একটা মহতী উদ্দেশ্য রয়েছে। সেটি হল যেসব স্বয়ংসেবক সংঘে নিয়মিত নন, তাঁদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগও হয় গুরুদক্ষিণা দিবস পালনের মাধ্যমে। বছরে অন্তত এই সময়টায় তাঁরা সংঘের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

    সংঘে এই গুরুদক্ষিণা কর্মসূচি পালনের আরও একটি উদ্দেশ্য হল সততার পাঠ দেওয়া। স্বয়ংসেবকরা গুরুদক্ষিণা হিসেবে যে অর্থ দান করেন, সেই অর্থের কানাকড়িও এদিক ওদিক হয় না। কোনও স্বয়ংসেবক কী পরিমাণ অর্থ দান করেন, তা দিয়ে তাঁদের যোগ্যতাও মাপা হয় না।

    ফি বার গুরুদক্ষিণা কর্মসূচি পালনের পর মুখ্যশিক্ষক দক্ষিণা বাবদ কত দান সংগৃহীত হল, তার হিসেব কষেন। যাঁরা দান দিয়েছেন, তাঁদের নাম এবং দানের অর্থের পরিমাণ সবই লিখে রাখা হয়। পরে সেই তুলে দেওয়া হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হাতে। সংগৃহীত অর্থ আরএসএসের বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়। গুরুদক্ষিণা বাবদ যে অর্থ আয় হয়, তার কানাকড়িও কেউ নেন না। তাই দুর্নীতির কোনও কথাও কশ্মিনকালেও ওঠেনি আরএসএসের ইতিহাসে। আরএসএস স্বয়ংসেবকদের চরিত্র গঠনের ওপর জোর দেয় নিরন্তর। তার জেরেই স্বয়ংসেবকরা উন্নত চরিত্রের হন। আরএসএসের কট্টর সমালোচকরাও সংঘের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারেনি কোনওদিন।

    আরএসএসে গুরুদক্ষিণা পালিত হয় বছরে একবার। এক পক্ষকাল কিংবা এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এই পুরো পর্ব জুড়ে হয় গুরুদক্ষিণার অনুষ্ঠান পালন। আরএসএসের জন্মলগ্ন থেকে এই পরম্পরায় ছেদ পড়েনি। শুধু তাই নয়, এই অনুষ্ঠান আরএসএসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম পবিত্র অনুষ্ঠানও। তাই আরএসএস গুরুদক্ষিণার অনুষ্ঠানটি পালন করে মর্যাদার সঙ্গে।

     

    (তথ্য সৌজন্য- ফার্স্টপোস্ট ডট কম)

  • CAA: নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছাড়া যে কোনও মুহূর্তেই উদ্বাস্তুরা হারাতে পারেন তাঁদের সারা জীবনের অর্জন

    CAA: নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছাড়া যে কোনও মুহূর্তেই উদ্বাস্তুরা হারাতে পারেন তাঁদের সারা জীবনের অর্জন

     

    মোহিত রায়

     

    যাঁরা নিত্য বিপদসংকুল জীবনযাপনে বাধ্য হন, তাঁরা ক্রমশঃ সেই বিপদের সম্ভাব্যতা ও ভয়াবহতা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যান। যে নির্মাণ শ্রমিক বাঁশের নড়বড়ে মাচায় কোনও নিরাপত্তার বন্দোবস্ত ছাড়াই রোজ কাজ করে যান তাঁর কাছে কোনও তথ্য পৌঁছয় না যে প্রতি বছরে কতজন এরকম নির্মাণ শ্রমিক দুর্ঘটনায় সম্মুখীন হন। কোনও বিপদ, সত্যি বা মিথ্যে, নিয়ে অনেক আলোচনা হলে মানুষ ভয় পায়। অর্থাৎ যে কোনও বিপদ সম্পর্কে, তার সম্ভাব্যতা বা ভয়াবহতা যাই হোক না কেন, মানুষের ভয় উদ্রেকের জন্য দরকার তা নিয়ে যথেষ্ট হৈচৈ করা। ভয় = বিপদ + হৈচৈ। যে সব ঘটনা বেশ হৈ চৈ ফেলে, টিভিতে চোখের সামনে আতঙ্ক ছড়ায় – খুন, জখম, আগুন – এসব খবর নিয়ে সংবাদমাধ্যম বেশ হৈচৈ করে। কিন্তু যে বিপদ নীরবে আসে যেমন সর্পাঘাতে মৃত্যু (ভারতে বছরে গড়ে ৫৮০০০ জন, প্রতিদিন প্রায় ১৬০ জন) তা নিয়ে খুব একটা কথাবার্তা হয় না। পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আসা নাগরিকত্বহীন লক্ষ লক্ষ মানুষ যে কোনও দিন আইনের নীরব সর্পাঘাতের অপেক্ষায় আছেন। বেশিরভাগ সেটা জেনেও ওই বাঁশের মাঁচার নির্মাণ শ্রমিকটির মতন ভবিতব্যের হাতে সব ছেড়ে বসে থাকেন। 

    নাগরিক না হলে কি হয়? ভারতের নাগরিকত্ব না থাকলে বা বিদেশ থেকে এসে এখানে থাকার উপযুক্ত কাগজপত্র না থাকলে আপনি দেশের ফরেনার্স অ্যাক্ট (বিদেশি আইন) ১৯৪৬ অনুযায়ী আপনি বিদেশি বলে গণ্য হবেন। এই অপরাধের জন্য সাজা পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাবাস হতে পারে এবং তারপর আপনি যে দেশের নাগরিক সেই দেশে আপনাকে ফেরত পাঠানো হতে পারে। কিন্তু এসবের থেকেও বড় কথা এতদিন ধরে আপনার অর্জিত অর্থে সঞ্চিত ব্যাঙ্কের টাকা, আপনার বাড়ি, গাড়ি – সবই বেআইনি বলে প্রশ্নের মুখে পড়বে। আপনি শুধু নন, ১৯৮৭-র ১ জুলাইয়ের পর আপনার ছেলেমেয়ের জন্ম হলে তারাও বেআইনি বিদেশি। সুতরাং মেয়ে বিদেশে পড়তে যাবে বলে যে পাসপোর্ট করিয়েছিলেন সেটার আর কোনও দাম নেই। আপনি সরকারি চাকরি করেন, আপনার ছেলেও কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি সবে পেয়েছে – এই সবই আপনি ও আপনার পুত্র হারাতে পারেন। অর্থাৎ আপনার অস্তিত্ব – আর্থিক, সাংসারিক সবই নির্ভর করছে নাগরিকত্বের উপর।

    আপনি বলবেন – আমার আধার কার্ড আছে, ভোটার কার্ড আছে, প্যান কার্ড আছে, রেশন কার্ড আছে।  এ সবই কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র। আর কি চাই। অনেক ছোটবড় নেতারাও তাই বলে বেড়াচ্ছেন। শ্রীমতী আলোরানি সরকার ভারতের নির্বাচন কমিশনের ছাড়পত্র নিয়ে ২০১৬ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির হয়ে ও ২০২১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ২০২১-এর নির্বাচনের পর কলকাতা হাইকোর্টে নির্বাচন সংক্রান্ত একটি মামলায় (GA 4 of 2022 EP/2/2021) আলোরানি সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি নাগরিকত্বের অভিযোগ আসে। আলোরানি সরকার নিজেকে ভারতীয় নাগরিক বলে দাবি করেন। গত ২০ মে বিচারক বিবেক চৌধুরী তাঁর রায়ে আলোরানি সরকারকে ভারতীয় নাগরিক মানতে অস্বীকার করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আলোরানি সরকার ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করেছেন। এই নিবন্ধে আমরা আদালতে থাকা এই মামলার বিষয়ে আলোচনা কেবলমাত্র নাগরিকত্বের বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখব, মামলার অন্যান্য বিষয়ে নয়।
     
    আলোরানি সরকারের কিন্তু আধার কার্ড ইত্যাদি সবই ছিল কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে “এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে পাসপোর্ট, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড ভারতের নাগরিকত্বের কোনও প্রমাণ নয়।” আলোরানি সরকারের দাবি ছিল যে তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয় কারণ তিনি ১৯৬৯ সালে বৈদ্যবাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু আদালত দেখেছে যে তাঁর বাবা-মা থাকেন বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) পিরোজপুর জেলায়। ছোটবেলায় আলোরানি তাঁর কাকার বাড়ি বৈদ্যবাটি চলে আসেন। ফলে তিনি ভারতে জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি ১৯৫৫-এর নাগরিকত্ব আইনের বিভিন্ন ধারায় নাগরিকত্বের আবেদন করার সুযোগ থাকলেও তা তিনি করেননি।

    আলোরানি এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ফলে তিনি ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইন বিভিন্ন ধারায় নাগরিকত্বের আবেদন করার যোগ্য ছিলেন। কিন্তু ১৯৭২ সালের পর বাংলাদেশ থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবার জন্য আবেদনের কোনও ব্যবস্থাই এতকাল ছিল না। সুতরাং এদেশে তাঁরা বেআইনি বিদেশি। এর প্রতিকারে ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে বলা হয়েছে যে, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে অথবা আশঙ্কায় যেসব ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন ও পার্শি সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে এসেছেন, যাঁদের ১৯২০ সালের পাসপোর্ট আইন ও ১৯৪৬ সালের বিদেশি আইন থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে – তাঁরা বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলে গণ্য হবেন না। 

    কিন্তু এই আইনের রুলস বা বিধি না চালু হওয়ার দরুণ উদ্বাস্তুরা আইন হওয়া সত্ত্বেও নাগরিক হতে পারছেন না। বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু উদ্বাস্তুদের উপর পুলিশ তাদের প্রয়োজন মতো নাগরিকত্বহীনতার অভিযোগ এনে, ফরেনার্স অ্যাক্ট (বিদেশি আইন) দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের বিভিন্ন ধরণের সমস্যায় ফেলছে – ভয় দেখিয়ে উৎকোচ নেওয়া থেকে শুরু করে কারাবাস। উদ্বাস্তু আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা এরকম অনেক ঘটনা জানেন, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আগত প্রায় দুই কোটি হিন্দু-মুসলমানের এই ভীষণ সমস্যা সাম্প্রতিক কয়েক বছর বাদ দিলে গত ৪০ বছরে সংবাদমাধ্যমে বা মানবাধিকার চর্চায় কখনও স্থান পায়নি। নীরব সর্পাঘাত কিন্তু ঘটেই চলেছে।

    ২০০৬ সালে একটি রাজনৈতিক দলের অভিযোগে হুগলির বলাগড়ের ৩৫ জন উদ্বাস্তুকে পুলিশ ফরেনার্স অ্যাক্টে গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন জেলবন্দি রাখে। এঁরা সবাই গৃহস্থ মানুষ কোনও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন। ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, জমির দলিল সব থাকা সত্ত্বেও আদালত তার কোনও মূল্য দেয়নি। ২০২০ সালে গোবরডাঙ্গা পুলিশ স্থানীয় সাংবাদিক রাজু দেবনাথকে গ্রেফতার করে কয়েকটি অপরাধ সংক্রান্ত মামলার সঙ্গে ফরেনার্স অ্যাক্টে মামলা দেয়। রাজু দেবনাথের দাবি, গোবরডাঙ্গা থানার পুলিশ আধিকারিকদের কিছু অপরাধমূলক কাজ জনসমক্ষে আনায় তাঁর বিরুদ্ধে এইসব মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে রাজু দেবনাথের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড, প্যান কার্ড দিয়ে নাগরিকত্ব প্রমাণ করা যায়নি। সম্প্রতি রাজু দেবনাথ জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।

    তাহলে বলাগড়ের উদ্বাস্তুরা, আলোরানি সরকার বা রাজু দেবনাথ – ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড, প্যান কার্ড – কোনটাই তাঁদের নাগরিকত্ব দেয়নি। সুতরাং অনেক দলের নেতারা গলা ফাটিয়ে, চটি প্রচার পুস্তিকায় অনেক যুক্তিতর্ক লিখলেও, এইসব কার্ড যে আদালতে মূল্যহীন তা বারবার প্রমাণিত। আরও মনে রাখবেন, সব ক্ষেত্রে আপনার বিরুদ্ধে কেউ মামলা করলে সাক্ষ্যপ্রমাণের দায়িত্ব – যে অভিযোগ করেছে তাঁর। কিন্তু একমাত্র ফরেনার্স অ্যাক্ট (বিদেশি আইন) ১৯৪৬-এ মামলা হলে প্রমাণের দায়িত্ব অভিযোগকারীর নয়, আপনার। সুতরাং আপনার ও পরিবারের ভবিষ্যৎ, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা – সব নির্ভর করছে আপনার আইনি নাগরিকত্বের প্রমাণে। আর এই নাগরিকত্বহীনতার সর্পাঘাতে বিদ্ধ হতে পারেন শুধু সাধারণ উদ্বাস্তুরা নন, বিদ্ধ হতে পারেন গোপন উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গের অনেক জনপ্রতিনিধি, বিধায়ক, সাংসদ, রাজ্য ও কেন্দ্রের মন্ত্রী। এখনই সচেষ্ট না হলে নীরবে সর্পাঘাতের জন্য তৈরি থাকুন। 

  • Sita Ram Goel Book: দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ভারতে ভাঙা হয়েছে ১৮০০-র বেশি মন্দির?

    Sita Ram Goel Book: দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ভারতে ভাঙা হয়েছে ১৮০০-র বেশি মন্দির?

    মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: দ্বাদশ শতাব্দীতে ভারত আক্রমণকারী মহম্মদ ঘোরির সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবকের (পরবর্তীকালে দিল্লির সুলতান) হাতেই না কি প্রথম আক্রান্ত হয়েছিল কাশীর আদি বিশ্বনাথ মন্দির। কয়েক বছর পর কাশীর বাসিন্দারা সংস্কার করেন মন্দিরটি। হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, সপ্তদশ শতকে (১৬৬৪ থেকে ’৬৯-এর মধ্যে) মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। আর সেই জমির একাংশে গড়ে তুলেছিলেন বর্তমান জ্ঞানবাপী মসজিদ। ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগও মসজিদ চত্বরে মন্দির থাকার নানা প্রমাণ পেয়েছে।

    তবে শুধু বাবরি মসজিদ, জ্ঞানবাপী মসজিদ বা মথুরার শাহী ইদগাহ নয়— ইসলামিক শাসকরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছিলেন, বলে দাবি করেছিলেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সীতারাম গোয়েল। তাঁর লেখা “Hindu Temples: What Happened to Them” বইতে এবিষয়ে তিনি বিশদ তথ্য দিয়েছেন। তাঁর মতে, ভারতের পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণের সমস্ত অঞ্চল জুড়েই মন্দির ধ্বংসের চিহ্ন রয়েছে। অরুণ শৌরি, হর্ষ নারায়ণ, জয় দুবাসী, রাম স্বরূপ এবং সীতারাম গোয়েল এই ঐতিহাসিক গ্রন্থটি রচনা করেন। বইটি দুই ভাগে বিভক্ত। গোয়েল ওই বইয়ে ১ হাজার ৮০০টি এরকম স্থাপত্যের উদাহরণ দেন, যেগুলি মন্দির ভেঙে তৈরি হয়।

    এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, সীতারাম গোয়েল তাঁর বইয়ে যে তালিকা প্রকাশ করেছেন তার এক ঝলক—

    অন্ধ্রপ্রদেশ: দক্ষিণের এই রাজ্যে এরকম ১৪২টি স্থান রয়েছে বলে নিজের বইতে দাবি করেছেন গোয়েল। তিনি লিখেছেন, অনন্তপুরের জামি মসজিদ, পেনুকোন্দার শের খাঁ-র মসজিদ, বাবিয়া দরগাগুলি তৈরি হয়েছে ইভারা মন্দির ভেঙে। এছাড়াও এই রাজ্যের নানা জায়গায় আরও নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। তাঁর দাবি, আলিয়াবাদের মামিন চুপ দরগাও মন্দির ভেঙেই হয়েছে। বেনুগোপালস্বামীর মন্দির ভেঙে তৈরি হয় রাজামুন্দ্রির জামি মসজিদ। ১৭২৯ সালে তৈরি গাছিনালা মসজিদও মন্দির ভেঙেই তৈরি হয়েছিল বলে নিজের বইয়ে লিখেছেন সীতারাম গোয়েল।

    আসাম: গোয়েল তাঁর বইতে লিখেছেন, কামরূপ জেলার হাজোতে মন্দির ভেঙে তৈরি হয়েছিল পোয়া মসজিদ এবং সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের মাজার।

    পশ্চিমবঙ্গ: গোয়েল তাঁর বইতে লিখেছেন, বাংলায় এরকম ১০২টি মসজিদ, দরগা, মুসলিম স্থাপত্য, দুর্গের খোঁজ মেলে যেগুলি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর তৈরি হয়েছে। বইতে তিনি লিখেছেন, বেনুগোপালের মন্দির ভেঙে লোকপুরে গাজি ইসমাইল মাজার তৈরি করা হয়। বীরভূমের মখদুম শাহ দরগায় মন্দিরের চিহ্ন পাওয়া যায়। গৌরে হিদু-রাজার রাজধানীর উপর ভিত্তি করেই মুসলিম শহর নির্মাণ করা হয়। ছোট সোনা মসজিদ, তাঁতিপারা মসজিদ, লাটান মসজিদ, মখদুম আঁখি সিরাজ চিস্তির দরগাও হিন্দু মন্দিরের উপর তৈরি বলে বইয়ে লিখেছেন গোয়েল।

    বিহার: বইতে গোয়েল লেখেন, এখানে এরকম ৭৭টি মুসলিম স্থাপত্য রয়েছে যার ভিত্তি হিন্দুদের ধর্মীয় স্থান। ১৫০২ সালে ভাগলপুরে হজরত শাহাবাজের দরগা, ১৬১৭ সালে গয়ার নাদিরগঞ্জে শাহি মসজিদ তৈরি হয়েছিল মন্দির ভেঙে। জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর তৈরি হয় চম্পানগরের বেশ কয়েকটি মাজার। নালন্দায় বৌদ্ধবিহার নষ্ট করে তৈরি করা হয় বিহারশরিফ। এছাড়াও নানা উদাহরণ রয়েছে।

    দিল্লি: গোয়েলের বইয়ে নানা প্রমাণ দেখিয়ে দাবি করা হয়েছে কুতুব মিনার-সহ প্রায় ৭২টি জায়গায় মন্দির  গুঁড়িয়ে দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল মসজিদ, দরগা, মাজার। পত্তন করা হয়েছিল নতুন নতুন নগরের।

    দিউ: গোয়েল লেখেন, এই শহরে ১৪০৪ সালে যেখানে জামি মসজিদ তৈরি হয় সেখানে আগে মন্দির ছিল। এর ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে।

    গুজরাট: গোয়েল তাঁর বইতে লিখেছেন, গুজরাটে এরকম ১৭০টি জায়গার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। আসাভাল, পাটন এবং চন্দ্রাবতীর মন্দিরগুলি ধ্বংস করে মুসলিম শহর আহমেদাবাদ তৈরি হয়। ভদ্রের প্রাসাদ এবং দুর্গ, আহমদ শাহের জামে মসজিদ, হাইবিত খান কি মসজিদ, রানি রূপমতি কি মসজিদ সবকিছু নির্মাণেই মন্দিরের জিনিস ব্যবহার করা হয়েছিল।

    গোয়েল লেখেন, ঢোলকা জেলায় বাহলোল খান গাজির মসজিদ ও মাজার এবং বরকত শহিদের মাজার মন্দিরের জায়গাতেই তৈরি হয়। ১৩২১ সালে, ভারুচের হিন্দু ও জৈন মন্দিরগুলি ধ্বংসের পর, তার উপকরণ ব্যবহার করেই জামি মসজিদ তৈরি করা হয়। ১৪৭৩ সালে দ্বারকায় মন্দির ভেঙে মসজিদ হয়। রান্দার থেকে জৈনদের বিতাড়িত করে তাঁদের মন্দিরগুলি মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়। 

    হরিয়ানা: বইতে গোয়েল দাবি করেছেন, ইতিহাসবিদরা হরিয়ানায় মোট ৭৭টি এরকম জায়গার খোঁজ পেয়েছেন। ১৬০৫ সালে ফরিদাবাদে, জামে মসজিদ একটি মন্দিরের জায়গাতেই তৈরি হয়।  ১৩৯২ সালে নুহতে মন্দিরের উপকরণ ব্যবহার করে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। ১২৪৬ সালে কাইথালে, বলখের শেখ সালাহুদ-দিন আবুল মুহাম্মদের দরগা তৈরিতে মন্দিরের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছিল। কুরুক্ষেত্রের টিলায় যে মাদ্রাসা তৈরি করা হয়, সেখানেও মন্দির ছিল। ফিরোজ শাহ তুঘলক আগ্রা থেকে আনা মন্দির সামগ্রী ব্যবহার করে হিসার তৈরি করেছিলেন। 

    হিমাচল প্রদেশ: গোয়েল লেখেন, হিমাচল প্রদেশের কাংড়ায় জাহাঙ্গির গেটটি মন্দিরের উপকরণ ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছিল।

    কর্ণাটক: বইতে গোয়েল লিখেছেন, দক্ষিণের এই রাজ্যে মোট ১৯২টি জায়গা রয়েছে যেখানে মন্দিরের চিহ্ন মেলে। বেঙ্গালুরুর ডোড্ডা বল্লাপুরে মুহিউদ্দিন চিস্তির দরগা, কুদাছিতে মখদুম শাহ ওয়ালির দরগা মন্দিরের উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি হয়। প্রাচীন হিন্দু শহর বিদার ও বিজাপুরকে মুসলিম রাজধানীতে রূপান্তরিত করা হয়। 

    কেরল: গোয়েলের মতে, ভারতের শেষপ্রান্তের এই রাজ্যে টিপু সিলতানের দুর্গ এবং কোলামে জামে মসজিদ নির্মাণে মন্দিরের ইঁট, কাঠ, পাথর ব্যবহার করা হয়।

    লাক্ষাদ্বীপ: তিনি লেখেন, লাক্ষাদ্বীপে এখন মুসলিম জনসংখ্যাই বেশি। কিন্তু একদা এখানে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল। এখানকার মহিউদ্দিন পালি মসজিদ, প্রতপালি মসজিদ নির্মাণ মন্দিরের উপকরণ ব্যবহার করা হয়।

    মধ্যপ্রদেশ: বইতে গোয়েল দাবি করেছেন, মধ্যপ্রদেশে এরকম ১৫১টি জায়গার সন্ধান পাওয়া যায় যেখানে মন্দিরগুলি মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। তিনি লেখেন, কুদসিয়া বেগম ভোপালে যেখানে জামে মসজিদ তৈরি করেন সেখানে একসময় সভামন্ডলা মন্দির ছিল। দামোহে গাজী মিঞার দরগা আগে মন্দিরের জায়গা ছিল। ধর ছিল রাজা ভোজ পরমারের রাজধানী। এটি মুসলিম রাজধানীতে রূপান্তরিত হয়। কামাল মওলা মসজিদ,লাট মসজিদ,আদবুল্লাহ শাহ চাঙ্গালের মাজার ইত্যাদিতে তৈরিতে মন্দিরের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাচীন হিন্দু শহর মান্ডুকে একটি মুসলিম শহর তৈরি করা হয়। জামে মসজিদ,দিলাওয়ার খান কি মসজিদ,ছোট জামে মসজিদ, মতি মসজিদ ইত্যাদি তৈরিতেও মন্দিরের সামগ্রী ব্যবহৃত হয়। 

    মহারাষ্ট্র: গোয়েল জানিয়েছেন, মহারাষ্ট্রে রয়েছে ১৪৩টি জায়গা, যেখানে মন্দির ভেঙে মসজিদ হয় বা মসজিদ তৈরিতে মন্দিরের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে, আহমেদনগরের অম্বা যোগী দুর্গ, গগ-এর ইদগাহ, করঞ্জের আস্তান মসজিদ, রিতপুরে ঔরঙ্গজেবের জামে মসজিদ উল্লেখযোগ্য। মুম্বইয়ের মহালক্ষ্মী মন্দিরকে ভেঙে তৈরি করা হয় ময়না হাজ্জামের মাজার। মুম্বইয়ের জামে মসজিদটিও একটি মন্দিরের জায়গায় নির্মিত হয়েছিল। লাতুরে, মিনাপুরী মাতার মন্দির ভেঙে হয় মাবসু সাহেবের দরগা। সোমেভরা মন্দিরকে ভেঙে সঈদ কাদিরির দরগা, রামচন্দ্র মন্দিরকে ভেঙে পাউনারের কাদিমি মসজিদ তৈরি হয়।

    ওড়িশা: গোয়েলের মতে, সমুদ্রপাড়ের এই রাজ্যে মোট ১২টি মুসলিম স্থাপত্যের জায়গায় মন্দিরের চিহ্ন পেয়েছেন ঐতিহাসিকেরা। বালেশ্বরে চণ্ডি মন্দিরের জায়গায় তৈরি হয় জামে মসজিদ। কটকের শাহী মসজিদের জায়গাতেও আগে মন্দির ছিল।

    পঞ্জাব: গোয়েল লিখেছেন, এখানে ১৪টি ইসলামিক স্থাপত্যের জায়গায় মন্দিরের নিদর্শন রয়েছে। ভাতিন্ডায় বাবা হাজি রতনের মাজার, লুধিয়ানায় দর মসজিদ, পাতিয়ালায় বাহাদুরগড় দুর্গের ভিতর মসজিদ তৈরি হয় মন্দিরের জায়গায়। জলন্ধরে বৌদ্ধ বিহারের উপর তৈরি হয় সুলতানপুরের বাদশাহি সরাই।

    রাজস্থান: রাজস্থানে এরকম ১৭০টি জায়গার উল্লেখ রয়েছে সীতারাম গোয়েলের বইয়ে। তিনি লিখেছেন, হিন্দু রাজার রাজধানী ছিল আজমের, যা পরবর্তীতে মুসলিম স্থাপত্য রীতির অনুকরণে তৈরি করা হয়। মন্দিরের জায়গাতেই ১২৩৬ সালে মুইনুদ্দিন চিস্তির দরগা তৈরি হয়। ঊষা মন্দির ভেঙে হয় বায়নার নোহারা মসজিদ। বিষ্ণু মন্দিরের উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি হয় ভিটারি-বাহারি মহল্লার মসজিদ। শেরগড়ে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন মন্দিরের সামগ্রী ব্যবহার করেই হয় শেরশাহ সুরির দুর্গ। লোহারপুরায় পীর জহিরুদ্দীনের দরগা, মাজার, নাগৌরে বাবা বদরের দরগা, সালাওতানের মসজিদ মন্দিরের জায়গায় নির্মিত হয়েছিল। 

    তামিলনাড়ু: গোয়েলের দাবি, দক্ষিণের এই রাজ্যে ১৭৫টি স্থানের কথা বলা হয়েছে যেখানে মন্দিরের চিহ্ন মেলে। তিরুচিরাপল্লীতে, নথর শাহ ওয়ালীর দরগা তৈরি হয় একটি শিব মন্দির ভেঙে। কোয়েম্বত্তুর, আন্নামালাই দুর্গ মেরামতের জন্য টিপু সুলতান মন্দিরের উপকরণ ব্যবহার করেছিলেন। চিংলেপুটের আচারওয়াকে শাহ আহমদের মাজার, কোভালামের মালিক বিন দিনারের দরগা একটি মন্দিরের উপর নির্মিত হয়। পাঁচ পদ্মমালাই পাহাড়ের নতুন নামকরণ করা হয় মওলা পাহাড়। একটি প্রাচীন গুহা মন্দিরের কেন্দ্রীয় হলটি মসজিদে পরিণত হয়। 

    উত্তর প্রদেশ: গোয়েলের দাবি, অযোধ্যার বাবরি মসজিদ, মথুরার শাহী ইদগাহ-সহ এই রাজ্যে ২৯৯টি স্থান রয়েছে যেখানে মন্দির ভেঙে মসজিদ বা ইসলামিক স্থাপত্য নির্মাণে মন্দিরের উপকরণ ব্যবহার করা হয়। বইয়ে বলা হয়েছে, আগ্রার কালান মসজিদ মন্দিরের উপকরণ ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছিল। আকবরের দুর্গে,ননদীর তীরবর্তী অংশটি জৈন মন্দিরের জায়গায় নির্মিত হয়। আকবরের মাকবারা একটি মন্দিরের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ইলাহাবাদে আকবরের দুর্গ, মিয়া মকবুল ও হোসেন খান শহিদের মাজার মন্দিরের উপর নির্মিত হয়েছিল। পাথর মহল্লায় মসজিদটি লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরকে ভেঙে তৈরি হয়।

    তিনি লেখেন, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছিল রাম জন্মভূমির উপর। যা এখন দেশের শীর্ষ আদালতও মেনে নিয়েছে। শাহ জুরান ঘুরির মাজার একটি মন্দিরের জায়গায় নির্মিত হয়েছিল। স্যার পাইগম্বর এবং আইয়ুব পইগম্বরের মাজার একটি বৌদ্ধ মন্দিরের জায়গায় তৈরি হয়, যেখানে বুদ্ধের পায়ের চিহ্ন ছিল। পাভা কারবালাও একটি বৌদ্ধ স্তূপের ধ্বংসাবশেষের উপর নির্মিত। গোরখপুরের ইমামবাড়া, লখনউতে  তিলেওয়ালি মসজিদ একটি মন্দিরের জায়গায় নির্মিত হয়েছিল। 

    তিনি আরও লেখেন, মেরঠের জামে মসজিদটি একটি বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে আছে। নৌচণ্ডীর দরগা ছিল নৌচণ্ডী দেবীর মন্দির। বারাণসীতে,জ্ঞানব্যাপি মসজিদটি বিশ্বেশ্বর মন্দিরের উপাদান ব্যবহার করে মন্দিরের জায়গাতেই তৈরি হয়েছিল। সম্প্রতি বিতর্কিত কাঠামোতে একটি শিবলিঙ্গের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। মথুরার শাহী ইদগাহ কৃষ্ণের জন্মভূমির উপরেই তৈরি, বলে বইতে দাবি করা হয়েছে।

    গোয়েল তার বইয়ে লিখেছেন যে তাঁর উল্লেখ করা তালিকাটি অসম্পূর্ণ। এটা শুধু একটি সংক্ষিপ্ত সারাংশ মাত্র। 

  • Rajbanshi People: উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনজাতি সত্যিই কি রাজবংশীয়?

    Rajbanshi People: উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনজাতি সত্যিই কি রাজবংশীয়?

    শুক্লা শিকদার

     

    “রাজবংশী” শব্দের আক্ষরিক অর্থ “রাজকীয় সম্প্রদায়”। ব্যুৎপত্তিগতভাবে রাজবংশী বলতে বোঝায় রাজার বংশধরদের। 

    প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, কোচ রাজবংশের উত্তরাধিকারদের একটি ধারা রাজবংশী জনজাতিগোষ্ঠীর সূচনা করেছে। কোচ উপজাতি থেকে উত্তরণ ঘটা কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজবংশী বা কোচ রাজবংশীদের একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং নিজস্ব ভাষা রয়েছে। রাজবংশীদের নিজস্ব ভাষা তাদের পূর্বপুরুষ কোচ আদিবাসীদের ভাষার তুলনায় পৃথক। রাজবংশীদের নিজস্ব ভাষা কোচ ভাষার মতো “অবশ্যই বিপন্ন” (Definitely Endangered) ভাষাও নয়, বরং রাজকীয় ভাষা হিসেবে জনপ্রিয়। 

    প্রাচীন কোচ উপজাতি থেকে উত্তরিত এই রাজবংশী জনজাতির জন্মভূমি ও বাসস্থানের মধ্যে রয়েছে তিব্বত, নেপাল, ভুটান, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশ, বিহার, অসম, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়সহ ভারতের উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন অংশ এবং ভারতের আত্মজ প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের উত্তর অংশের রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চল। বর্তমানেও উক্ত বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রাজবংশীরা এবং তাঁদের লোকতত্বাতিক ইতিহাস।

    রাজবংশীরা যারা কোচদের সঙ্গে উত্পত্তিগতভাবে এক, যাদের কোচদের একই বর্ণের (caste) সদস্য হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল, তারা তাদের উন্নীত বংশমর্যাদার নিরিখে ১৯১০ সালে ক্ষত্রিয় রাজবংশী বলে নিজেদের নতুনভাবে সনাক্ত করতে আন্দোলনে নামল। কোচ রাজবংশের উত্তরাধিকারগণ ছাড়াও সামাজিকভাবে উচ্চ মর্যাদার অভিলাসী কোচরা এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। কোচদের আদিবাসী পরিচয় ও অ-হিন্দু সংস্কৃতি থেকে পৃথক একটি নতুন পরিচয় আন্দোলনকারীরা দাবি করেছিল। 

    পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের একজন রাজবংশী নেতা এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন পঞ্চানন বর্মা, যিনি ঠাকুর পঞ্চানন বা পঞ্চানন সরকার নামেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন। একপর্যায়ে ক্ষত্রিয় রাজবংশী পরিচয়ের দাবিদার কোচদের মধ্যে আন্দোলন অনেকটা সংগঠিত হয় এবং পঞ্চানন বর্মার নেতৃত্বে তারা বর্তমান বাংলাদেশের রংপুরে ক্ষত্রিয় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অর্থাৎ দীর্ঘকালীন সাংগঠনিক আন্দোলন ও সুসংহত নেতৃত্বের দ্বারা কোচদের একটি অংশ নিজেদের মূলগত আদিবাসী পরিচয় বর্জন করে নিজেদের ক্ষত্রিয় রাজবংশী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। মূলত সেই কারণেই একমাত্র মেঘালায় ছাড়া অন্য কোনও ভারতীয় রাজ্যে কোচ বংশোদ্ভূতগণ সাংবিধানিকভাবে তফশিলি উপজাতি হিসেবে নথিভুক্তি লাভ করেনি।

    A Census report of Bengal, 1872 অনুযাযী কোচ উপজাতির মধ্যে তিনটি ভাগ— কোচ, রাজবংশী ও পোলিয়া। যে পোলিয়া জনজাতির অস্তিত্ব পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুরেও রয়েছে। W W Hunter কর্তৃক রচিত Statistical Account of Bengal, 1876 অনুযায়ী, কোচ থেকেই রাজবংশী জনজাতি উদ্ভুত হয়েছে। তাঁর মতে, রাজবংশীরা অর্ধ-হিন্দু ও আদিবাসী জনজাতিভুক্ত। 

    নৃতত্ববিদ ভুবন মোহন দাসও (B M Das 1933-2008) তাঁর Among the people of North East India : the diary of an anthropologist,  রচনায় উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসী জনজীবনের উপর তাঁর ক্ষেত্রসমীক্ষা ভিত্তিক নিরীক্ষণের মাধ্যমে আলোকপাত করেছেন। দেহতাত্ত্বিক (Physical-anthropology) ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান (Social Cultural Anthropology) এর আলোকে তিনিও রাজবংশীদের কোচ থেকে উদ্ভুত বলে সনাক্ত করেছেন। মূলগত কোচ জনজাতির মধ্যে সংস্কৃত ও হিন্দুধর্মের প্রতি অনুরক্ত জনগোষ্ঠীরাই রাজবংশী বলে অনেকে মনে করেন। 

    বিজ্ঞানী EDWARD GAILS- এর মতেও হিন্দু ধর্মের প্রতি অনুরক্ত কোচরাই রাজবংশী। রাজবংশী জনজাতির মধ্যে বিভিন্ন গোত্রের অস্তিত্ব রয়েছে। রয়েছে দোভাষীয়া রাজবংশী, মদেশী রাজবংশী। রয়েছে রায়বর্মন পদবি থেকে কোচ পদবি।

    ( লেখিকা নৃতত্ববিদ, মতামত লেখিকার ব্যক্তিগত )

  • Rajbanshi People: খাদ্যাভ্যাস থেকে সংস্কৃতি, কেমন হয় রাজবংশী জনজাতির জীবনধারা?

    Rajbanshi People: খাদ্যাভ্যাস থেকে সংস্কৃতি, কেমন হয় রাজবংশী জনজাতির জীবনধারা?

    শুক্লা শিকদার

    একটি সাম্প্রতিক গবেষণা নির্দেশ করে যে রাজবংশী বা কোচ রাজবংশী জনজাতির কৃষি, নৃত্য, সঙ্গীত, চিকিৎসা অনুশীলন, গান, বাড়ি নির্মাণ, সংস্কৃতি এবং ভাষার মৌখিক ঐতিহ্য রয়েছে। ২০১৯ সালের উক্ত গবেষণা অনুসারে, রাজবংশী জনজাতি আদর্শভাবে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে জ্ঞান ও জীবনশৈলীর খুঁটিনাটি হস্তান্তর করে আসছে। 

    কোচ রাজবংশী জনজাতি ঐতিহ্যগতভাবে একটি বৃহৎ কৃষিজীবী জনজাতির অঙ্গ ছিল। তারা মূলত ধান, ডাল এবং ভুট্টা চাষাবাদে অভ্যস্থ ছিল। রাজবংশী জনজাতির মধ্যে অধিকাংশের প্রধান খাদ্য ভাত। এমনকি একবিংশ শতকেও, এই জনজাতির একটি বড় অংশ এখনও গ্রামীণ জীবনধারা মেনে চলে। যদিও ক্রমশ নগরায়নের প্রভাব তাদের জীবনধারায়ও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবে অসম, পশ্চিমবঙ্গ, নেপাল, বাংলাদেশ, মেঘালয়ের সমস্ত রাজবংশী জনজাতির মধ্যে খাদ্য ও পানীয়ের গ্রহণে লক্ষণীয় সামঞ্জ্যস্য দেখা যায়। অর্থাৎ অঞ্চলিক বিভিন্নতা সত্ত্বেও কোচ জনজাতির খাদ্যপ্রণালী একই রকম। তাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় শাকসবজি এবং ভাজা (প্রধানত আলু) সহ চাল এবং ডাল পাওয়া যায়। 

    ঢেকির সাগ এবং নাফা সাগ, দুই ধরনের শাক-সবজি রাজবংশীদের মধ্যে খুবই প্রচলিত। ফার্নের পাতার সদ্য জন্মানো অঙ্কুর জাত তেল থেকে খুব অল্প পরিমান তেল ব্যবহার করে তারা শাক সবজি সাধারণত সিদ্ধ করে খান। নাম্নী অসমে, বাঁশের অঙ্কুরকেও সবজি হিসেবে প্রস্তুত করে খাওয়া হয়। কোচ রাজবংশীর মধ্যে বাসি ভাত বা পান্তা ভাত খাওয়া দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় খুবই  প্রচলিত। শাক-সবজি ব্যতীত অন্যান্য রান্না প্রধানত সরিষার তেল ব্যবহার করে করা হয়, যদিও কখনও কখনও সূর্যমুখী তেল ব্যবহার করা হয়। 

    আমিষ জাতীয় খাবারের ক্ষেত্রে, কোচ রাজবংশী জনগোষ্ঠী বঙ্গীয় অঞ্চলের অন্যান্য আশেপাশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ ভাবে প্রচুর পরিমাণে মাংস এবং ডিম খায়, যেখানে বঙ্গীয় অঞ্চলের জনজতিরা আমিষ হিসেবে মৎস আহারে বেশি স্বচ্ছন্দ। মাংস হিসেবে তাদের ছাগল এবং ভেড়ার মাংসই বেশি পছন্দ। রাজবংশীদের পূর্বপুরুষ কোচ আদিবাসীরা পাখির মাংস আস্বাদনে অভ্যস্থ হলেও, সামাজিক উত্তরণের অভিপ্রায়ে সংস্কৃতায়ন পদ্ধতি অবলম্বন করার জন্য রাজবংশীরা পাখির মাংস খাওয়াতে নিরুৎসাহ দেখায়। 

    আরও পড়ুন: উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনজাতি সত্যিই কি রাজবংশীয়?

    রাজবংশী জনজাতির মধ্যে ঘোড়দেউ পূজায় শূকর এবং লক্ষ্মী পূজায় হাঁস বলি দেওয়ার রীতি ছিল। যে এখনও কিছুটা প্রচলিত রয়েছে। হাঁস ও মুরগির ডিম খাওয়ার প্রচলনও রয়েছে তাদের মধ্যে। সময় বিশেষে তাদের হাঁস এবং মাছও খেতেও দেখা যায় তবে খুব সীমিত ক্ষেত্রে। বহুবর্ষজীবী না হওয়ায় প্রাকৃতিক কারণেই উত্তরবঙ্গের নদীগুলো বড় জাতের বিভিন্ন প্রকারের ও বড় জাতের মাছ ধারণ করতে পারে না। যদিও, নাম্নী অসম অঞ্চলে, ব্রহ্মপুত্রের মতো বড় নদ ও অন্যান্য নদীগুলি বিভিন্ন ধরণের মাছ ধারণ করে যা সেখানে বসবাসকারী কোচ রাজবংশীদের খাদ্যাভ্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠেছে।

    একটি সাধারণ কোচ রাজবংশী বাড়ির বাড়ির নকশা অপরিহার্যভাবে আয়তক্ষেত্রাকার হবে এবং বাড়ির মাঝখানে একটি খোলা জায়গা থাকবে। বেশিরভাগ বন্য প্রাণী এবং শক্তিশালী বাতাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য বাড়ির এরকম নকশা করা হয়। প্রতিটি কোচ-রাজবংশী বাড়িতে প্রবেশদ্বারে মনসার ঠাকুরঘর বা কালী ঠাকুর থাকা আবশ্যক। রাজবংশী বাড়িতে উত্তর দিকে সাধারণত  সুপারি এবং ফলের বাগান থাকে, পশ্চিমে বাঁশের বাগান থাকে, পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক সাধারণত খোলা রাখা হয় যাতে রোদ এবং বাতাস ঘরে প্রবেশ করতে পারে। যদিও জমিদার স্থানীয় রাজবংশীদের মধ্যে এইভাবে বসতবাড়ির সামগ্রিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়।

    কোচ-রাজবংশীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের মধ্যে রয়েছে প্রধানত পাটানি, অগ্রণ, অঙ্গশা, চাদর, লিফান, ফোটা এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী পোশাক। তাদের বাড়িতেই তাদের ঐতিহ্যবাহী তাঁতে বোনা হয়। পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হল অঙ্গশা এবং জামা, আর মহিলাদের জন্য হল বুকুনি-পাটানি, ফোটা, অগ্রান, অঙ্গসা, লিফান- চাদর বুকের চারপাশে বাঁধা এক টুকরো কাপড় যা হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। লিফান বা ফোটা একটি মোড়কের মত পরা হয়। কোচ রাজবংশী উপজাতি এখনও তাদের পুরানো জাতিগত পোশাকগুলি সংরক্ষণ করেছে এবং নিয়মিতভাবে তাদের সাধারণ পোশাক হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, কোচ রাজবংশীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করতে পছন্দ করে যদিও আধুনিক পোশাকগুলি ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়।

    ( লেখিকা নৃতত্ববিদ, মতামত লেখিকার ব্যক্তিগত )

  • TMC Syndicate War: সবার উপরে সিন্ডিকেট সত্য, তাহার উপরে নাই!

    TMC Syndicate War: সবার উপরে সিন্ডিকেট সত্য, তাহার উপরে নাই!

    তৃণমূল জমানায় পশ্চিমবঙ্গে সিন্ডিকেট রাজের বাড়বাড়ন্ত নতুন কথা নয়। দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধী শিবিরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শাসক দলের বদান্যতায় রাজ্যে সিন্ডিকেট রাজ কার্যত ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। শহর হোক বা গ্রামাঞ্চল– সর্বত্রই সিন্ডিকেট বিরাজমান। কিন্তু, সাম্প্রতিককালে, সিন্ডিকেটের এই নির্লজ্জ ও খুল্লমখুল্লা আস্ফালন যেভাবে দিকে দিকে প্রতিফলিত হয়েছে বা হচ্ছে, তা সম্ভবত কোনওদিন এরাজ্যে হয়নি।

    গত ডিসেম্বরে বিপুল সংখ্যা নিয়ে কলকাতা পুরভোটে জয়ী হয় রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। অথচ, তার পাঁচ মাসের মধ্যেই, পুরসভার ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে শুরু হয়ে গিয়েছে সিন্ডিকেট-দৌরাত্ম্য। বেহালা হোক বা লেক গার্ডেন্স কিংবা বাঁশদ্রোণী– দিকে দিকে সিন্ডিকেটের এই গ্যাং-ওয়ার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার কঙ্কালসার অবস্থা। 

    বিগত কয়েকদিনের মধ্যেই কলকাতার একাধিক এলাকায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ঘটনা সামনে এসেছে। গত বৃস্পতিবার বেহালাতে চড়ক মেলার দখলদারি ঘিরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ঘটনায় জখম হয় বেশ কয়েকজন।
    অন্যদিকে, সোমবারই লেক গার্ডেন্সেও এমনই বখরার ভাগ নিয়ে গন্ডগোল বাধে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। ঘটনাচক্রে, গন্ডগোলটি ঘটে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের বাড়ির সামনেই। এটাই শেষ নয়। সম্প্রতি, বাঁশদ্রোণীতেও দেখা গিয়েছে একই ছবি। সিন্ডিকেটের দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে ভরদুপুরে কলকাতার রাস্তায় প্রকাশ্যে চলে গুলি। সেই গুলির আঘাতে জখম হন দুই ব্যক্তি। যার জেরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এলাকা। 

    সিন্ডিকেটের এই দৌরাত্ম্য কতটা বেড়েছে, তার প্রমাণ বঙ্গবাসী হাতে গরমে পেয়েছে চলতি সপ্তাহে, যেখন সিন্ডিকেট-দুষ্কৃতীদের দুই গোষ্ঠীর গুলির লড়াইয়ে অতিষ্ট হয়ে বাধ্য হয়ে পুলিশকে ফোন করতে হচ্ছে শাসক দলেরই সাংসদকে! তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় থাকেন লেক গার্ডেন্সে। তাঁর বাড়ির পাশেরই সিন্ডিকেটের বিবাদে ধুন্ধুমারকাণ্ড বেঁধে যায় গোটা এলাকায়। স্থানীয় সূত্রে খবর সিন্ডিকেট কার হাতে থাকবে এই নিয়ে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করা হয় পরস্পর গোষ্ঠীকে। ধারালো অস্ত্রের কোপে আহত হন ৭ জন। গন্ডগোলের আওয়াজ শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। তিনি ফোন করেন লেক থানায়।

    শাসক শিবির যতই বিষয়টিকে “ছোট বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা” হিসেবে উল্লেখ করুক না কেন, সিন্ডিকেট নিয়ে দলের সাংসদের মন্তব্যেই স্পষ্ট, সমস্যা কোন পর্যায়ে গিয়েছে। প্রবীণ এই নেতাকে বলতে শোনা যায়, “এখানে ৬০ বছর আছি। নকশাল আমল দেখেছি। কোনওদিন এরকম ঘটনা দেখিনি। রেল কলোনির আন্দোলন করেছি। লেকগার্ডেন্স এরকম কোনও ঘটনা কখনও ঘটেনি।” ঘটনায় যথেষ্টই ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত সাংসদ সৌগত রায়৷ সংবাদমাধ্যমের সামনে সিন্ডিকেট নিয়ে গন্ডগোলের কথা স্বীকারও করে নিয়েছেন তিনি৷  

    শাসক শিবির যাই দাবি করুক না কেন, সিন্ডিকেট রোগ তৃণমূলের আজকের নয়। এটা দীর্ঘদিন ধরেই শাসক দলের শীর্ষস্তরের বদান্যতায় ভেতরে-ভেতরে শক্তিবৃদ্ধি করেছে। একটা সময়ে সিন্ডিকেটের বাড়বাড়ন্ত এবং গোষ্ঠী কোন্দলের জেরে বার বার খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল রাজারহাট এবং নিউটাউনের নাম। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল। রাজারহাট – নিউটাউন এলাকায় সিন্ডিকেট ব্যবসা নিয়ে শাসকদলের দুই দু গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই থাকত। সেখানে বিল্ডারদের নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহের জন্য এই ‘সিন্ডিকেটগুলির’ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে টিএমসি সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার এবং দলের বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের মধ্যে শত্রুতা বাংলায় সুপরিচিত ছিল।

    এখন, রাজারহাট-নিউটাউনের সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্য থাকলেও, কিছুটা নিষ্প্রভ। কিন্তু, শহরের অন্য প্রান্তে তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ফলে, সিন্ডিকেটের এই রোগ — তা সে ভাইরাসই হোক বা ব্যাক্টেরিয়া কিংবা ছত্রাক– শাসক দলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে রয়েছে। বদল হচ্ছে তো শুধু আক্রান্ত এলাকার নাম। 

     

  • TMC Agitation at Calcutta HC: বেনজির বিক্ষোভের সাক্ষী হাইকোর্ট, এবার তৃণমূলের রোষে খোদ বিচারপতি

    TMC Agitation at Calcutta HC: বেনজির বিক্ষোভের সাক্ষী হাইকোর্ট, এবার তৃণমূলের রোষে খোদ বিচারপতি

    মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: রাজ্যের বর্তমান শাসক শিবিরের রোষের মুখে বারবার পড়তে হয়েছে বিরোধী দলগুলিকে। এটা নতুন কিছু নয়। বিরোধিতা করায় অনেক শিল্পী থেকে বুদ্ধিজীবীকেও হুমকি-হুঁশিয়ারি সহ্য করতে হয়েছে। এমনকী, অপ্রিয় সত্য খবর লেখার জন্য রাজ্য সরকারের শ্যেনদৃষ্টির সামনা-সামনি হতে হয়েছে ও হতে হচ্ছে সংবাদমাধ্যমকেও। 

    কিন্তু, ১৩ এপ্রিল এই সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল তৃণমূলের ‘দাদাগিরি’।  এবার রাজ্যের শাসক শিবিরের রক্তচক্ষুর সামনে খোদ বিচারপতি! বলা ভাল, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। যা ঘিরে বেনজির দৃষ্টান্তের সাক্ষী থাকল কলকাতা হাইকোর্ট। 

    কিন্তু, কেন হঠাৎ এই বিচারপতিকে টার্গেট করা শুরু করল তৃণমূল? বিচারপতি আবার কী ‘দোষ’ করলেন? আসলে এই যে রাজ্যে একের পর এক মামলা বা ঘটনার তদন্তভার পুলিশের হাত থেকে সরিয়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে সিবিআইয়ের হাতে, এটাই ঘটনার মূল কারণ। 

    ভাদু শেখ থেকে বহটুই, তপন কান্দু থেকে হাঁসখালি — গত দশ দিনের মধ্য়ে রাজ্য পুলিশের অধীনে থাকা পাঁচটি মামলা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে উচ্চ আদালত। আর সবকটিই নির্দেশই দিয়েছে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। বলা বাহুল্য, এতে রাজ্য সরকারের মুখ  যারপরনাই পুড়েছে। হাইকোর্টের এই নির্দেশে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, রাজ্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলার ওপর আদালতের একেবারেই ভরসা নেই। 

    এই সব মামলার নির্দেশের ফলে, তৃণমূল যে চরম অস্বস্তিতে পড়েছিল, তা প্রমাণিত। এর ওপর তাতে ঘৃতাহুতি পড়ে এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের হেভিওয়েট মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ের উদ্দেশ্যে দেওয়া অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের দৃষ্টান্ত-স্থাপনকারী নির্দেশ। 

    কিছুদিন আগে, গরু ও কয়লা পাচারকাণ্ডের তদন্তের স্বার্থে তৃণমূলের দাপুটে নেতা তথা বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে ডেকে পাঠিয়েছিল সিবিআই। হাজিরার দিন, সিবিআই দফতর না পৌঁছে অনুব্রত সটান গিয়ে ভর্তি হয়ে যান এসএসকেএম হাসপাতালে।

    এমন ঘটনা যে প্রথম তেমনটা নয়। অতীতেও দেখা গিয়েছে সিবিআই তলব করতেই, তৃণমূলের একাধিক নেতা অসুস্থ হয়ে গিয়ে এই এসএসকেএমের দ্বারস্থ হয়েছেন। অনুব্রতর ক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। আদালত তা নজরে রেখেছিল।

    এদিকে, স্কুল সার্ভিস কমিশনের গ্রুপ-সি ও গ্রুপ-ডি এবং নবম-দশম শ্রেণিতে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। সেই প্রেক্ষিতে পার্থকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানোর জন্য উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সেই প্রক্ষিতেই অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ জানায়, হাজিরা দিতে হবে পার্থকে। এমনকী, তিনি এসএসকেএমে ভর্তিও হতে পারবেন না বলে নির্দেশ দেন বিচারপতি।

    এই নির্দেশের ফলেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তৃণমূলের রোষে পড়েন। যার নিটফল হল হাইকোর্টে তৃণমূলপন্থী আইনজীবীদের বিক্ষোভ-প্রদর্শন। যাঁদের মূল দাবি, বিচারপতি পরপর একপেশে নির্দেশ দিচ্ছেন। সেই জন্য অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্য়ায়ের বেঞ্চ বয়কটের দাবি তোলেন তাঁরা। 

    তবে, রোষের মুখেও অবিচল বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, দুর্নীতি দেখলে চুপ থাকতে পারবেন না। এজলাসে বিক্ষোভকারীদের তিনি কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। বিক্ষোভকারী তৃণমূলপন্থী আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “আপনার হয়তো রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি দেখলে আদালত চুপ থাকবে না। যে দুর্নীতি করবে, সে যে রাজনৈতিক দলের হোক না কেন ছেড়ে দেওয়া হবে না।” 

    প্রবল বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েও নিজের সিদ্ধান্তে অটল এই দৃঢ়চেতা বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “আমার মাথায় বন্দুক ধরতে পারেন। মরতে রাজি। কিন্তু দুর্নীতি দেখে চুপ থাকবে না আদালত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চলবে!” 

    সাম্প্রতিককালে, রাজ্যে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনাপ্রবাহে তৃণমূলের পায়ের তলার জমি ক্রমশ সরে যাচ্ছে। তা রাজ্যের শাসক দল ভালই টের পাচ্ছে। ফলস্বরূপ, দলের মধ্য়েও শুরু হয়েছে কোন্দল, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এমনকী, খোদ দলের সুপ্রিমো তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর গলাতে শোনা গিয়েছে একাধিক হঠকারী ও বিতর্কিত মন্তব্য। 

    তার ওপর আদালতের পরের পর নির্দেশে প্রবল সমালোচনার মুখে রাজ্যের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। অতএব, এসব বিষয়টিকে মাথায় রেখেই তৃণমূলের লক্ষ্য এখন সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে কব্জা করা। সেটা না করতে পেরে নৈরাশ্যের চরম উদাহরণ তুলে ধরছে রাজ্যের শাসক দল।

  • Shyama Prasad Mukherjee: জন্মদিনে ফিরে দেখা ভারত-কেশরী শ্যামাপ্রসাদ

    Shyama Prasad Mukherjee: জন্মদিনে ফিরে দেখা ভারত-কেশরী শ্যামাপ্রসাদ

    বেঁচে থাকলে বয়স হত ১২১ বছর। কিন্তু ১২১ লাইনও কেউ খরচ করলেন না শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্য। গত শতাব্দীর প্রথম বছরে জন্ম শ্যামাপ্রসাদের। অথচ তাঁর পিতা আশুতোষ মুখোপাধ্যাকে নিয়ে বাঙালির প্রজ্ঞার উৎসাহ দেখার মত। কিন্তু তাঁরই সন্তান, তার মতই শিক্ষাবিদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কমবয়সী উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদকে রেখে দেওয়া হয়েছিল সেই অন্ধকারেই। এর পিছনে বাংলার রাজনীতি যেমন দায়ী, তেমনই দায় ইতিহাস বিস্মৃত বাঙালি জাতির। যারা কোন দিন সচেতন ভাবে চর্চা করলেন না গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে দাপিয়ে বেড়ানো এই বাঙালি মনীষার ওপর।

    বহুদিন ভুলিয়ে রাখার পর যখন শ্যামাপ্রসাদ চর্চা শুরু হল, তখন থেকে নিত্য দিন নতুন ভাবে বাঙালি চিনতে শুরু করলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। যিনি একাধারে শিক্ষক-উপাচার্য। একাধারে সচেতন রাজনীতিবিদ। যোগ্য বিধায়ক, সাংসদ।  এবং একজন দার্শনিক। যার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফসল আজ সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। 

    শুধু শিক্ষাবিদ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে নিয়েই লিখে ফেলা যায় গোটা প্রবন্ধ। কিন্তু অল্প কথায় জেনে নেওয়া যাক, এই মেধাবী প্রজ্ঞার সম্পর্কে। ১৯৩৪ সাল, শ্যামাপ্রসাদের বয়স মাত্র তেত্রিশ বছর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। চার বছরের মেয়াদ। চৌত্রিশ থেকে আটত্রিশ সাল। এই চার বছরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রায় ঢেলে সাজানোর কাজ করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। শিক্ষাবিদ শ্যামাপ্রসাদের হাত ধরেই, দীর্ঘদিনের প্রায় আশি বছরের ইংরাজির জগদ্দল সরিয়ে বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ আসে বাঙালি মেধায়। এছাড়া মহিলাদের জন্য বিশেষ পাঠক্রম ও হোম সায়েন্সের পঠনপাঠন চালু করা ও কৃষিবিদ্যা নিয়ে লেখাপড়ার শুরুও তাঁর হাতে। এমনকি রাজ্য যখন শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে উত্তাল, তখন আরও বেশি করে মনে করা উচিত শিক্ষাবিদ শ্যামাপ্রসাদকে। কারণ তাঁর হাত ধরেই শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাঠক্রম চালু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিদেশি ভাষা শিক্ষায় তিনি জোর দেন চিনা আর তিব্বতি ভাষায়। হিন্দি, উর্দু, অহমিয়া ভাষা শিক্ষাতেও জোর দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৩৭ সালের সমাবর্তনে প্রথমবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভাষণ দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। 

    ১৯৩৯ সাল। ব্রিটিশ শাসকের সঙ্গে কংগ্রেসের একটা বড় অংশের আপোষের মনোভাব। কারণ দেশের বড়লোকেদের প্রতিনিধিত্ব করছিল কংগ্রেস। গান্ধীর অহসযোগ, অহিংস আন্দোলনের সঙ্গে সশস্ত্র আন্দোলনের বিরোধ তখন তুঙ্গে। দেশের স্বাধীনতার যোদ্ধারা পথ খুঁজছেন ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর বছর। যুগসন্ধিক্ষণের সময়। ভারতের রাজনীতিতে ঘটে গেল এক বিচিত্র ঘটনা। বাংলার দুই রাজনীতিবিদ কংগ্রেস ছাড়লেন। একজন সুভাষচন্দ্র বসু, আরেকজন অবশ্যই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। কংগ্রেসের ব্রিটিশ আপোষকামী রাজনীতির বিরোধিতা করে দুজনে হাঁটলেন দুই পথে। সুভাষচন্দ্র যখন তৈরি করছেন ফরওয়ার্ড ব্লক, ঠিক তখনই শ্যামাপ্রসাদ যোগ দিচ্ছেন ‘হিন্দু মহাসভা’য়। ১৯৩৯ সাল। সাভারকরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হিন্দু মহাসভায় যোগদান শ্যামাপ্রসাদের। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ঠিক তাঁর পরের বছর, ১৯৪০, কার্যনির্বাহী সভাপতি করা হয় তাঁকে।  ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সাল। হিন্দু মহাসভা সভাপতি হিসেবে কাজ করেছেন শ্যামাপ্রসাদ। 

    সময়টা লক্ষ্য করুন, ১৯৪২-এ ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়েছে। যার বিরোধিতা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। কংগ্রেসের ভিতরেও তখন দোটানা, দোলাচল। ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস নাকি পূর্ণ স্বাধীনতা? কংগ্রেসের ভিতরে বাইরে বিতর্ক চরমে পৌছাচ্ছে। এর আগেই ১৯০৫ সালে বাংলায় দ্বিজাতি তত্ত্বের বীজ বপন করে গেছে ব্রিটিশরা। তাঁর বিষময় ফল ফলতে শুরু করেছে দেশে। ১৯২৯ সালে বাংলা প্রভিন্সের বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের টিকিটে প্রথমবার নির্বাচিত হয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। মাঝে কেটে গেছে ১৪ বছর। ততদিনে বুঝে গেছেন শ্যামাপ্রসাদ, বাংলার পরিণতি কি হতে চলেছে। কারণ ১৯২৯-৩০ সালের অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে উজ্জ্বল। স্পষ্ট কংগ্রেসের ভূমিকাও। কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা বাংলার আইনসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। দলের নীতি মেনে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন শ্যামাপ্রসাদও। কিন্তু নিজস্ব অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন, আইনসভার ভিতরে থেকেই লড়াই চালাতে হবে। প্রয়োজনে কৌশলগত অবস্থান নিতে হবে। সেই কারণে ১৯৩০ সালেই নির্দল হিসেবে জিতে আসেন নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষেত্র থেকে। কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কের হয়তো সেখানেই ইতি। এরপরে অবশ্য ফজলুর হকের মন্ত্রী সভার অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন যোগ্যতার সঙ্গে। 

    ঠিক যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থার দিনগুলি। ক্লাসে তাঁর উপস্থিতিকেই ভয় পেতেন তাঁর মেধাবী সহপাঠীরা। জানতেন শ্যামাপ্রসাদ যে ক্লাসে থাকবেন সেখানে তিনিই টপার হবেন। মন্ত্রীসভাতেও তেমনি। আইনসভার ভিতরে শ্যামাপ্রসাদের ব্যক্তিত্ব যুক্তিবোধ আর বাগ্মীতা সহজেই নজর কাড়ল। বাড়ছিল জনপ্রিয়তাও। ফলে বিরোধিতাও এল। কারণ ফজলুর হকের পার্টি তখন মুসলিম লিগের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে গিয়ে চরম অবস্থানে পৌঁছাচ্ছে। বাংলার চেহারা তখন দুই প্রান্তে দুরকম। পশ্চিমপ্রান্তে হিন্দু আধিক্য থাকলেও মুসলিমদের হাতে অর্থনীতির চাবিকাঠি। ঠিক তাঁর উলটো ছবি পূর্ব প্রান্তে। লড়াইটা দাঁড়িয়ে গেছিল দেশ ভাগের প্রশ্নে। বাংলার অবস্থান কোনদিকে থাকবে। যে বাঙালি হিন্দুর মেধার কাছে নেতৃত্বের কাছে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে কংগ্রেসের তৎকালীন নেতারা নিয়ম করে হেরে যাচ্ছেন। যতবার হারছেন, ততবার গান্ধীজিকে সামনে রেখে পলায়নের পথ খুঁজছিলেন সেই সময়ের নেহেরু ফলোয়াররা। তাঁরা চাইছিলেন পাকিস্তানের অংশ হোক বেশিরভাগ বাংলা। বাকি অংশ জুড়ে দেওয়া হোক বিহার ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে। হিন্দু বাঙালি সত্ত্বার রাজনীতি নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন যে মানুষটা তিনিই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। 

    মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা ঠেকাতে মুখার্জি ১৯৪৬ সালেই বঙ্গভঙ্গের দাবি জানান। তারকেশ্বরে ১৫ এপ্রিল ১৯৪৭ তারিখে হিন্দু মহাসভার ডাকে একটি সভা তাঁকে বঙ্গভঙ্গ নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার অনুমোদন দেয়। ১৯৪৭ সালের মে মাসে, শ্যামাপ্রসাদ লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে একটি চিঠি লেখেন, যাতে বলা হয়, ভারত না হলেও বাংলাকে অবশ্যই ভাগ করতে হবে। সে সময়, ১৯৪৭-এ শরৎ বসু এবং বাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দাবি ছিল একটি অখন্ড কিন্তু স্বাধীন বাংলার। শ্যামাপ্রসাদ এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার, ভাগ না হলে পশ্চিম অঞ্চলে হিন্দু অধ্যুষিত বাংলা ধ্বংস হয়ে যাবে।
     
    ঠিক সেই সময়ে পূর্ব বাংলায় নোয়াখালী গণহত্যা। যেখানে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে হিন্দুগণহত্যা চালানো হয়েছিল। মুসলিম লীগের হিন্দু সাফাই অভিযানের পিছনে যে রাজনীতি লুকিয়ে ছিল তা হল, সেই সময়ে মুসলিম লীগের প্রস্তাব। যে প্রস্তাবে বলা হল, সমগ্র বাংলাপ্রদেশকে পাকিস্তানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। যা হবে, ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের জন্য একটি স্বদেশ। এইখানেই বোঝা যায়, শ্যামাপ্রসাদের দূরদর্শিতা। হিন্দু বাঙালির নিজস্ব বাসভূমির পক্ষে তাঁর সওয়াল দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করেছিল অবিভক্ত বাংলার হিন্দু সমাজকে। এরপর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি নেতৃত্বে “বেঙ্গলি হোমল্যান্ড মুভমেন্ট” শুরু হয়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ১৯৪৭-এর দেশভাগ, বলা ভাল বাংলা ভাগকে মেনে নেন বাঙালি হিন্দু জনগণ। যা আসলে স্বাধীন ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে নিজেদের জন্য একটি বাসস্থান, আবাসভূমি। যাকে আমরা আজকের দিনে পশ্চিমবঙ্গ বলে চিনি।   

    ২১ জুন পশ্চিমবাংলার জন্মদিন। আর তাঁকেই ভুলে গেছিল বাংলার মানুষ।

    জন্মদিনের প্রণাম ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদ।   

     

     

     

     

     

     

  • Bengali Hindu Homeland: ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব রক্ষার ঘোষণা

    Bengali Hindu Homeland: ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব রক্ষার ঘোষণা

    মোহিত রায়

     

    পশ্চিমবঙ্গ যুক্ত বাংলার পশ্চিম ভাগের শুধু একটি মানচিত্র মাত্র নয়, এটি বাঙালি হিন্দুর মুক্তির ভাবনা। সাড়ে পাঁচশ বছরের ইসলামী শাসন বাংলার কয়েক হাজার বছরের ধর্ম সংস্কৃতি ভাষাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। বাংলায় তাই নেই কোনও প্রাচীন মন্দির, বৌদ্ধ বিহার। বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণে হিন্দু-বৌদ্ধের বাংলাকে বানানো হয়েছে ইসলাম প্রধান বাংলা। ব্রিটিশ শাসন এই দুঃশাসন থেকে মুক্তি দেয়, বাঙালির নবজাগরণের অগ্রদূত রাজা রামমোহন রায় যাকে বলেছেন “ডিভাইন প্রভিডেন্স বা বিধির আশীর্বাদ”। 

    ১৮৭২ সালের প্রথম জনগণনার পর সরকারীভাবে প্রতিষ্ঠিত হল বাংলায় মুসলমান জনসংখ্যা হিন্দুর চেয়ে কিছু বেশী। ১৯৩১ পর্যন্ত এ পার্থক্য তেমন বেশি ছিল না। ৫৫ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ হিন্দু। কিন্তু এই সুযোগেই ব্রিটিশ সরকার আনল ১৯৩৫ সালের সাম্প্রদায়িক চুক্তি বা কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড। বাংলার আইনসভায় মুসলমান আসন হল ১৩০ টি। হিন্দু আসন, তফসিলি আসন মিলিয়ে, মাত্র ৯০। 

    এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডাঃ নীলরতন সরকার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা। তাঁদের বিবৃতিতে তাঁরা খুব স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন যে সংখ্যায় মুসলমানরা বেশি হলেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, ব্যাবসা বানিজ্য সবকিছুতেই হিন্দুরা অনেক এগিয়ে। সুতরাং বাংলার ভালমন্দের সিদ্ধান্ত কেবল জনসংখ্যার মানদণ্ডে হতে পারে না। বাংলার কংগ্রেস, বিশেষতঃ সুভাষচন্দ্র বসু, এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন।

    ১৯৩৫-এর কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড মেনে ১৯৩৭-এর নির্বাচন থেকে শুরু হল আবার মুসলিম লিগের ইসলামী শাসন। স্বাধীনতা ও দেশভাগের আবহাওয়ায় তপ্ত হয়ে উঠল বাংলায় ইসলামী অত্যাচার। ১৯৪৬-এর কলকাতার মহাদাঙ্গা ও নোয়াখালীর হিন্দু গণহত্যার পর বাঙালি হিন্দু বুঝে গেল আগামী দিনে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলায় তাদের অবস্থা কী হবে। 

    এগিয়ে এলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সরব হলেন বাংলার মনীষীরা। ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, শিশির মিত্র, নমশুদ্র নেতা প্রমথরঞ্জন ঠাকুর বললেন বাঙালি হিন্দুর হোমল্যান্ড চাই। এগিয়ে এলেন বাংলার কংগ্রেস নেতারাও, ডাঃ বিধান রায়, অতুল্য ঘোষ। 

    বাঙালি হিন্দুর কয়েক হাজার বছরের ধর্ম সংস্কৃতি বাঁচাতে, হিন্দু নারীর সম্মান রক্ষার্থে, বাঙালি হিন্দুর নিজের বাসস্থানের দাবিতে তৈরি হল পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গীয় আইনসভা বাংলা ভারত বা পাকিস্তান যোগদানের প্রশ্নে একমত হল না। তখন হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে হল পশ্চিমবঙ্গ আইনসভা ও মুসলমান প্রধান অঞ্চল নিয়ে হল পূর্ববঙ্গ আইনসভা। 

    পশ্চিমবঙ্গ আইন সভায় সংখ্যাধিক্যের ভোটে পশ্চিমবঙ্গের ভারতভুক্তি নিশ্চিত হয়। যুক্ত বাংলার সব মুসলমান সদস্যরা পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেন, কতিপয় তফসিলি সদস্য ছাড়া সব তফসিলি সদস্য সহ সব হিন্দু সদস্যরা ভারতভুক্তির পক্ষে ভোট দেন। পশ্চিমবঙ্গ গঠনের পক্ষে ভোট দেন কমিউনিস্ট জ্যোতি বসু ও রতনলাল ব্রাহ্মণ। বাংলাকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার বিরুদ্ধে ভোট দেন মতুয়া গুরু পি আর ঠাকুর।

    ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস উদযাপন এই ভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার। কেউ বলছেন, আমরা বাংলায় বিভাজন করছি। বিভাজন তো হয়ে গেছে আজ থেকে আটশো বছর আগে যখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আগুনে পুড়িয়ে বখতিয়ার খিলজি বাঙলায় ঢুকল। তারপর থেকে বাঙলার একটিও পুরনো মন্দির আর দাঁড়িয়ে নেই। যতদিন ত্রিবেনীর জাফর খানের মসজিদ, আদিনার মসজিদ অপসারিত না হচ্ছে ততদিন বিভাজন তো থাকবেই। 

    পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করাই আমাদের প্রাথমিক কাজ। আজ খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে হবে বাংলায় কথা বললেই সে বাঙালি নয়, তাকে পাঁচ হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতার উত্তরাধিকারও স্বীকার করতে হবে। বাংলাভাষী ও বাঙালি এক নয়। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দু আজ বহন করছে সেই উত্তরাধিকারের দায়িত্ব। পারসী, সিন্ধি, কাশ্মিরী পণ্ডিতদের আজ আর নিজেদের দেশ নেই, তাঁরা হারিয়ে যাচ্ছেন ভারতের বিভিন্ন কোণে, হারিয়ে যাচ্ছে তাঁদের ভাষা-সংস্কৃতি।

    শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিমবঙ্গ গড়েছিলেন বলেই আজও বাঙালি হিন্দু তাঁর ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আর কতদিন? পশ্চিমবঙ্গকে পাকিস্তান বানাতে ইসলামী মৌলবাদী শক্তি নাগরিকত্ব আইন ও এনারসির বিরোধিতায় রাজ্য সরকারের প্রশ্রয়ে ১৩ থেকে ১৫ ডিসেম্বর সারা বাংলা জুড়ে হিংসাত্মক আক্রমণ চালায়। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের পশ্চিমবঙ্গকে আমরা ধ্বংস করতে দেব না। সেজন্যই আজ প্রয়োজন পশ্চিমবঙ্গ প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বোঝা ও দিকে দিকে ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করা।

     

    (মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

LinkedIn
Share