মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: মহালয়ার অমাবস্যা তিথিতে পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের (Durga Puja 2025) সূচনা হয়। পরের দিন, অর্থাৎ শুক্ল প্রতিপদ তিথি থেকে শুরু হয় নবরাত্রি (Navaratri 2025)। যা চলে দুর্গা নবমী পর্যন্ত। এই নবরাত্রিতে দেবী দুর্গা নয়টি ভিন্ন রূপে পূজিতা হন। নবদুর্গার (Nabadurga) এই নয়টি রূপ হল— দেবী শৈলপুত্রী, দেবী ব্রহ্মচারিণী, দেবী চন্দ্রঘণ্টা, দেবী কুষ্মাণ্ডা, দেবী স্কন্দমাতা, দেবী কাত্যায়নী, দেবী কালরাত্রি (Devi Kalratri), দেবী মহাগৌরী এবং দেবী সিদ্ধিদাত্রী।
নবরাত্রির সপ্তম দিনে আরাধিত হন দেবী কালরাত্রি (Devi Kalratri)। বাংলাতে প্রচলিত দুর্গাপুজোর মহাসপ্তমীর (Durga Puja 2025) দেবী তিনি। দেবী কালরাত্রি ভীষণ দর্শনা, এলোকেশী। তাঁর চারটি হাত। ওপরের ডান হাতে আশীর্বাদ, নীচের ডান হাতে অভয় মুদ্রা। বাঁ দিকে ওপরের হাতে খড়্গ এবং নীচের বাম হাতে রয়েছে লোহার কাঁটা। দেবী ত্রিনয়নী এবং তাঁর চোখগুলি গোলাকার। দেবীর গলায় রয়েছে বজ্রের মালা। এই দেবীর বাহন গাধা এবং তাঁর নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ভয়ঙ্কর অগ্নিশিখা নির্গত হয় বলে কথিত আছে। দেবী কালরাত্রি সম্পর্কে অজস্র পৌরাণিক আখ্যান রয়েছে। তিনি চণ্ড-মুণ্ড নামের দুই অসুরকে বধ করেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর অপর নাম তাই চামুণ্ডা।
শুম্ভ ও নিশুম্ভের কাহিনি…
দেবী মাহাত্ম্যতে উল্লেখ রয়েছে, শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক দুই দানব ছিল। তারা প্রজাপতি ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করল। খুশি হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা বর দিতে আবির্ভূত হলেন। দুই দানব বর চাইল যে কোনও পুরুষ যেন তাদের বধ করতে না পারেন। ব্রহ্মা তাঁদের কাঙ্ক্ষিত বর প্রদান করলেন। দুই অসুর চরম অত্যাচার শুরু করল দেবতাদের ওপর। এই দুজনের সঙ্গে যোগ দিলেন চণ্ড-মুণ্ড নামের আরও দুই অসুর। তাঁদের সঙ্গে এল রক্তবীজ। যাঁর প্রতিটি রক্তবিন্দু মাটিতে পড়লে দ্বিতীয় রক্তবীজ তৈরি হবে। এমনটাই বরদান ছিল তাঁর ওপর প্রজাপতি ব্রহ্মার। এই সমস্ত অসুরদের অত্যাচারে দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। অসুরদের ওপর ব্রহ্মার বরদান সম্পর্কেও দেবতারা অবগত ছিলেন। মুনি-ঋষিদের যজ্ঞ পণ্ড করা, ঋষি কন্যাদের নানা ভাবে লাঞ্ছিত করা এসব কাজ তো চলছিলই। অসুরদের এমন আক্রমণে দেবতারা অবশেষে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। নিজেদের স্বর্গরাজ্য থেকে তাঁরা বিতাড়িত হলেন।
দেবী পার্বতীর কালরাত্রি হয়ে ওঠার কাহিনি
দেবতারা হিমালয়ের কোলে শুরু করলেন দেবীর (Devi Kalratri) স্তব। পুরাণে কথিত রয়েছে, এমন সময় সেখান দিয়ে শিবজায়া দেবী পার্বতী গঙ্গাস্নানের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন। দেবী তাদের স্তব শুনে বললেন, হে দেববৃন্দ, আপনারা এখানে কার স্তব করছেন? সেই সময় ভগবতী পার্বতীর শরীর থেকে একই রকম দেখতে আর এক জন দেবী বেরিয়ে এলেন। আবির্ভূত হয়ে নব দেবী (Durga Puja 2025) বললেন, দেবতারা আমার স্তব করছেন। এই দেবীই আদ্যাশক্তি জগত মাতা অম্বিকা মহামায়া। তিনি দেবী পার্বতীর কোষ থেকে সৃষ্টি হয়েছেন বলে তার এক নাম কৌশিকী। কথিত আছে, এরপর নাকি দেবী পার্বতী কৃষ্ণবর্ণা হয়ে যান। যাঁকে আমরা কালরাত্রি বলি। ইনি দেবী কালিকা নামেও পরিচিত।
পুরাণে আরও উল্লেখিত আছে, দেবী একদিন হিমালয়ে সিংহপৃষ্ঠে বসে মধু পান করছিলেন। এমন সময় চণ্ড আর মুণ্ড নামক দুই দানব দেবীকে দেখতে পেলেন। চণ্ড-মুণ্ড একথা গিয়ে শুম্ভ-নিশুম্ভকে জানালেন। শুম্ভ-নিশুম্ভ সেই দেবীর রূপ বর্ণনা শুনে দেবীকে লাভ করার জন্য আকুল হলেন। সুগ্রীব নামক এক অসুর দেবীর কাছে গেলেন শুম্ভ-নিশুম্ভের দূত হিসেবে। সুগ্রীব হিমালয়ে সেই পর্বত চূড়ায় গিয়ে দেবীকে শুম্ভ-নিশুম্ভের পরাক্রম, ঐশ্বর্যের কথা বলে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। দেবী একথা শুনে হেসে বললেন, আমার প্রতিজ্ঞাটি শোনো। যিনি আমাকে যুদ্ধে জয় করবেন, তিনিই আমার স্বামী হবেন।
দেবী কালরাত্রির আবির্ভাব
এরপর শুম্ভ-নিশুম্ভের সেনাপতি ধুম্রলোচন ষাট হাজার সেনা নিয়ে গেলেন দেবীকে পরাজিত করতে। দেবীর তেজে ধুম্রলোচন ভস্মীভূত হলেন। দেবীর সিংহবাহিনী অসুর সেনাকে ধ্বংস করে দিল। শুম্ভ-নিশুম্ভ এরপর চণ্ড-মুণ্ডকে পাঠালেন। চণ্ড-মুণ্ড বহু সেনা, অশ্ব, রথ, হাতি নিয়ে যুদ্ধে এলেন। তাঁরা হিমালয়ের চূড়ায় হাস্যরত দেবী অম্বিকাকে দেখতে পেলেন। এরপর দেবী চণ্ডিকা তাঁদের দেখে ভীষণ ক্রুদ্ধা হলেন। ক্রোধে তাঁর মুখমণ্ডল কৃষ্ণবর্ণা হলেন। তখন দেবীর কপাল থেকে এক ভীষণ দর্শনা দেবী প্রকট হলেন। সেই দেবী কালিকা বা কালরাত্রি। অতি ভীষণা, ভয়ঙ্করী, কোটর গতা, আরক্ত চক্ষু বিশিষ্টা।
সেই ভয়ঙ্করা দেবী ভীষণ হুঙ্কার দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন। কতগুলি অসুরকে দেবী তাঁর চরণ ভারে পিষে বধ করলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে এই ভাবে দেবী অসুরদের ধ্বংস করে ফেললেন। এরপর দেবী তাঁর খড়গ তুলে ‘হং’ শব্দ করে চণ্ডের দিকে ধেয়ে গেলেন। দেবী চণ্ডের চুলের মুঠি ধরে খড়গ দ্বারা এক কোপে চণ্ডের শিরোচ্ছেদ করে ফেললেন। চণ্ড অসুর বধ হল। চণ্ড নিহত হয়েছে দেখে ক্রোধে মুণ্ড দেবীর দিকে ধেয়ে গেলেন। দেবী তাঁর রক্তাক্ত খড়গ দিয়ে আর এক কোপে মুণ্ডের শিরোচ্ছেদ করলেন। চণ্ড-মুণ্ড বধ হতে দেখেই দেবতারা আনন্দে দেবীর জয়ধ্বনি দিতে থাকলেন।
দেবী মাহাত্ম্য (Durga Puja 2025) অনুযায়ী, চণ্ড আর মুণ্ডের ছিন্ন মস্তক নিয়ে দেবী, মহামায়ার কাছে এসে বিকট হেসে বললেন, “এই যুদ্ধরূপ যজ্ঞে আমি আপনাকে চণ্ড ও মুণ্ড নামের দুই মহাপশুর মস্তক উপহার দিলাম। এখন আপনি নিজেই শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করবেন।” দেবী অম্বিকা তখন বললেন, “হে দেবী, যেহেতু তুমি চণ্ড ও মুণ্ডের বধ করে মাথা দুটি আমার নিকট নিয়ে এসেছ। সেজন্য আজ থেকে তুমি জগতে ‘চামুণ্ডা’ নামে বিখ্যাত হবে।” দেবী কালরাত্রি শুভফলের দেবী (Durga Puja 2025) বলেও অনেকে মনে করেন। তাই দেবীর আরেক নাম হল শুভঙ্করী। দেবী কালরাত্রির (Devi Kalratri) আশীর্বাদে জীবনের সমস্ত কুপ্রভাব বিনষ্ট হয় বলে ভক্তদের ধারণা। মাতার নৈবেদ্যতে গুড় নিবেদন করলে তিনি প্রসন্না হন বলে ভক্তদের বিশ্বাস।