Tag: Ramakrishna Paramahansa

  • Ramakrishna 494: “‘সকলের খেলেই কি জ্ঞান হয়? কুকুর যা তা খায়, তাই বলে কি কুকুর জ্ঞানী?”

    Ramakrishna 494: “‘সকলের খেলেই কি জ্ঞান হয়? কুকুর যা তা খায়, তাই বলে কি কুকুর জ্ঞানী?”

    ৪৮ শ্রীরামকৃষ্ণ কাপ্তেন, নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১৩ই জুন
    ঠাকুরের গলার অসুখের সূত্রপাত

    “মার পাদপদ্মে ফুল দিয়ে যখন সব ত্যাগ করতে লাগলাম, তখন বলতে লাগলাম, ‘মা! এই লও তোমার শুচি, এই লও তোমার অশুচি; এই লও তোমার ধর্ম, এই লও তোমার অধর্ম; এই লও তোমার পাপ, এই লও তোমার পুণ্য; এই লও তোমার ভাল, এই লও তোমার মন্দ; আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও।’ কিন্তু এই লও তোমার সত্য, এই লও তোমার মিথ্যা এ-কথা বলতে (Kathamrita) পারলাম না।”

    একজন ভক্ত বরফ আনিয়াছিলেন। ঠাকুর (Ramakrishna) পুনঃপুনঃ মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “হাঁগা খাব কি?”

    মাস্টার বিনীতভাবে বলিতেছেন, “আজ্ঞা, তবে মার সঙ্গে পরামর্শ না করে খাবেন না।”

    ঠাকুর অবশেষে বরফ খাইলেন না।

    শ্রীরামকৃষ্ণ—শুচি-অশুচি—এটি ভক্তি ভক্তের পক্ষে। জ্ঞানীর পক্ষে নয়। বিজয়ের শাশুড়ী বললে, ‘কই আমার কি হয়েছে? এখনও সকলের খেতে পারি না!’ আমি বললাম, ‘সকলের খেলেই কি জ্ঞান হয়? কুকুর যা তা খায়, তাই বলে কি কুকুর জ্ঞানী?’

    (মাস্টারের প্রতি)—“আমি পাঁচ ব্যান্নন দিয়ে খাই কেন? পাছে একঘেয়ে হলে এদের (ভক্তদের) ছেড়ে দিতে হয়।

    “কেশব সেনকে বললাম, আরও এগিয়ে কথা বললে তোমার দলটল থাকে না!

    “জ্ঞানীর অবস্থায় দলটল মিথ্যা—স্বপ্নবৎ।…

    “মাছ ছেড়ে দিলাম। প্রথম প্রথম কষ্ট হত, পরে তত কষ্ট হত না। পাখির বাসা যদি কেউ পুড়িয়ে দেয়, সে উড়ে উড়ে বেড়ায় (Kathamrita); আকাশ আশ্রয় করে। দেহ, জগৎ—যদি ঠিক মিথ্যা বোধ হয়, তাহলে আত্মা সমাধিস্থ হয়।

    “আগে ওই জ্ঞানীর অবস্থা ছিল। লোক ভাল লাগত না। হাটখোলায় অমুক একটি জ্ঞানী আছে, কি একটি ভক্ত আছে, এই শুনলাম; আবার কিছুদিন পরে শুনলাম, ওই সে মরে গেছে! তাই আর লোক ভাল লাগত না। তারপর তিনি (মা) মনকে নামালেন, ভক্তি-ভক্ততে মন রাখিয়ে দিলেন।”

    মাস্টার অবাক্‌, ঠাকুরের (Ramakrishna) অবস্থা পরিবর্তনের বিষয় শুনিতেছেন। এইবার ঈশ্বর মানুষ হয়ে কেন অবতার হন, তাই ঠাকুর বলিতেছেন।

  • Ramakrishna 493: “বড় গরম পড়াতে মাস্টারেরও শরীর অসুস্থ, মাকে বলেছি, মা! ভাল করে দাও, আর কুলপি খাব না”

    Ramakrishna 493: “বড় গরম পড়াতে মাস্টারেরও শরীর অসুস্থ, মাকে বলেছি, মা! ভাল করে দাও, আর কুলপি খাব না”

    ৪৮ শ্রীরামকৃষ্ণ কাপ্তেন, নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে

     প্রথম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১৩ই জুন
    ঠাকুরের গলার অসুখের সূত্রপাত

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna) দক্ষিণেশ্বরে কালীমন্দিরে সেই পূর্বপরিচিত ঘরে বিশ্রাম করিতেছেন। আজ শনিবার, ১৩ই জুন, ১৮৮৫, (৩২শে জৈষ্ঠ, ১২৯২) জৈষ্ঠ শুক্লা প্রতিপদ, জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তি। বেলা তিনটা। ঠাকুর খাওয়া-দাওয়ার পর ছোট খাটটিতে একটু বিশ্রাম করিতেছেন।

    পণ্ডিতজী মেঝের উপর মাদুরে বসিয়া আছেন। একটি শোকাতুরা ব্রাহ্মণী ঘরের উত্তরের দরজার পাশে দাঁড়াইয়া আছেন। কিশোরীও আছেন। মাস্টার আসিয়া প্রণাম করিলেন। সঙ্গে দ্বিজ ইত্যাদি। অখিলবাবুর প্রতিবেশীও বসিয়া আছেন। তাঁহার সঙ্গে একটি আসামী ছোকরা।

    ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একটু অসুস্থ আছেন। গলায় বিচি হইয়া সর্দির ভাব। গলার অসুখের এই প্রথম সূত্রপাত।

    বড় গরম পড়াতে মাস্টারেরও শরীর অসুস্থ। ঠাকুরকে সর্বদা দর্শন করিতে (Kathamrita) দক্ষিণেশ্বরে আসিতে পারেন নাই।

    শ্রীরামকৃষ্ণ(Ramakrishna)—এই যে তুমি এসেছ। বেশ বেলটি। তুমি কেমন আছ?

    মাস্টার—আজ্ঞা, আগেকার চেয়ে একটু ভাল আছি।

    শ্রীরামকৃষ্ণ—বড় গরম পড়েছে। একটু একটু বরফ খেও। আমারও বাপু বড় গরম পড়ে কষ্ট হয়েছে। গরমেতে কুলপি বরফ—এই সব বেশি খাওয়া হয়েছিল। তাই গলায় বিচি হয়েছে। গয়ারে এমন বিশ্রী গন্ধ দেখি নাই।

    “মাকে বলেছি, মা! ভাল করে দাও, আর কুলপি খাব না।

    “তারপর আবার বলেছি, বরফও খাব না।”

    শ্রীরামকৃষ্ণ ও সত্যকথা—তাঁহার জ্ঞানী ও ভক্তের অবস্থা

    “মাকে যেকালে বলছি ‘খাব না’ আর খাওয়া হবে না। তবে এমন হঠাৎ ভুল হয়ে যায়। বলেছিলাম (Ramakrishna), রবিবারে মাছ খাব না। এখন একদিন ভুলে খেয়ে ফেলেছি।

    “কিন্তু জেনে-শুনে হবার জো নাই। সেদিন গাড়ু নিয়ে একজনকে ঝাউতলার দিকে আসতে বললুম। এখন সে বাহ্যে গিছল, তাই আর-একজন নিয়ে এসেছিল। আমি বাহ্যে করে এসে দেখি যে, আর-একজন গাড়ু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে গাড়ুর জল নিতে পারলুম না। কি করি? মাটি দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম—যতক্ষণ না সে এসে জল দিলে(Kathamrita)।

  • Ramakrishna 492: “কি আশ্চর্য, মহাপুরুষ, ইনিও প্রাকৃত লোকের ন্যায় নিদ্রায় অভিভুত হইয়া শুইয়া আছেন”

    Ramakrishna 492: “কি আশ্চর্য, মহাপুরুষ, ইনিও প্রাকৃত লোকের ন্যায় নিদ্রায় অভিভুত হইয়া শুইয়া আছেন”

    ৪৫ শ্রীরামকৃষ্ণের কলিকাতায় ভক্তমন্দিরে আগমন —
    শ্রীযুক্ত গিরিশ ঘোষের বাটীতে উৎসব

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ২৪শে এপ্রিল
    ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামের বাটীতে অন্তরঙ্গসঙ্গে

    নরেন্দ্র, মাস্টার, যোগীন, বাবুরাম, রাম, ভবনাথ, বলরাম, চুনি 

    শুক্রবার (১২ই বৈশাখ, ১২৯২) বৈশাখের শুক্লা দশমী, ২৪শে এপ্রিল, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna) আজ কলিকাতায় আসিয়াছেন। মাস্টার আন্দাজ বেলা একটার সময় বলরামের বৈঠকখানায় গিয়া দেখেন, ঠাকুর নিদ্রিত। দু-একটি ভক্ত কাছে বিশ্রাম করিতেছেন।

    মাস্টার একপার্শ্বে বসিয়া সেই সুপ্ত বালক-মূর্তি দেখিতেছেন। ভাবিতেছেন, কি আশ্চর্য, এই মহাপুরুষ, ইনিও প্রাকৃত লোকের ন্যায় নিদ্রায় অভিভুত হইয়া শুইয়া আছেন। ইনিও জীবের ধর্ম স্বীকার করিয়াছেন।

    মাস্টার আস্তে আস্তে একখানি পাখা লইয়া হাওয়া করিতেছেন। কিছুক্ষণ পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নিদ্রাভঙ্গ হইল। এলোথেলো হইয়া তিনি উঠিয়া বসিলেন। মাস্টার ভূমিষ্ঠ হইয়া তাঁহাকে প্রণাম ও তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিলেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম অসুখের সঞ্চার—এপ্রিল ১৮৮৫

    শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি সস্নেহে)—ভাল আছ? কে জানে বাপু! আমার গলায় বিচি হয়েছে। শেষ রাত্রে বড় কষ্ট হয়। কিসে ভাল হয় বাপু? (চিন্তিত হইয়া)—আমের অম্বল করেছিল, সব একটু একটু খেলুম। (মাস্টারের প্রতি)—তোমার পরিবার কেমন আছে? সেদিন কাহিল দেখলুম; ঠাণ্ডা একটু একটু দেবে।

    মাস্টার—আজ্ঞা, ডাব-টাব?

    শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, মিছরির সরবৎ খাওয়া ভাল।

    মাস্টার—আমি রবিবার বাড়ি গিয়েছি।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—বেশ করেছ। বাড়িতে থাকা তোমার সুবিধে। বাপ-টাপ সকলে আছে, তোমায় সংসার তত দেখতে হবে না।

    কথা কহিতে কহিতে ঠাকুরের মুখ শুকাইতে লাগিল। তখন বালকের ন্যায় জিজ্ঞাসা করিতেছেন, (মাস্টারের প্রতি)—আমার মুখ শুকুচ্চে। সবাই-এর কি মুখ শুকুচ্চে?

    মাস্টার — যোগীনবাবু, তোমার কি মুখ শুকুচ্চে?

    যোগীনদ্র — না; বোধ হয়, ওঁর গরম হয়েছে।

    এঁড়েদার যোগীন ঠাকুরের অন্তরঙ্গ; একজন ত্যাগী ভক্ত।

    ঠাকুর এলোথেলো হয়ে বসে আছেন। ভক্তেরা কেহ কেহ হাসিতেছেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—যেন মাই দিতে বসেছি। (সকরের হাস্য) আচ্ছা, মুখ শুকুচ্চে, তা ন্যাশপাতি খাব? কি জামরুল?

    বাবুরাম—তাই বরং আনি গে—জামরুল।

    শ্রীরামকৃষ্ণ—তোর আর রৌদ্রে গিয়ে কাজ নাই।

    মাস্টার পাখা করিতেছিলেন (Kathamrita)।

    শ্রীরামকৃষ্ণ—থাক, তুমি অনেকক্ষণ—

    মাস্টার—আজ্ঞা, কষ্ট হচ্চে না।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্নেহে)—হচ্চে না?

    মাস্টার নিকটবর্তী একটি স্কুলে অধ্যাপনা কার্য করেন। তিনি একটার সময় পড়ান হইতে কিঞ্চিৎ অবসর পাইয়া আসিয়াছিলেন। এইবার স্কুলে আবার যাইবার জন্য গাত্রোত্থান করিলেন ও ঠাকুরের পাদবন্দনা করিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—এক্ষণই যাবে?

    একজন ভক্ত—স্কুলে এখনও ছুটি হয় নাই। উনি মাঝে একবার এসেছিলেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে)—যেমন গিন্নি—সাত-আটটি ছেলে বিয়েন—সংসারে রাতদিন কাজ—আবার ওর মধ্যে এক-একবার এসে স্বামীর সেবা (Kathamrita) করে যায়। (সকলের হাস্য)

  • Ramakrishna 491: “কামিনী-কাঞ্চন ছাদ! ছাদ তুলে না ফেললে কি সূর্যকে দেখা যায়! সংসারী লোক  ঘরের ভিতর বন্দী!”

    Ramakrishna 491: “কামিনী-কাঞ্চন ছাদ! ছাদ তুলে না ফেললে কি সূর্যকে দেখা যায়! সংসারী লোক ঘরের ভিতর বন্দী!”

    ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    সপ্তম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
    ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও অবতারতত্ত্ব

    “তা হোক। ওদের দোষ নাই। সকলে কি সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দকে ধরতে পারে? রামচন্দ্রকে বারজন ঋষি কেবল জানতে পেরেছিল। সকলে ধরতে পারে না। কেউ সাধারণ মানুষ ভাবে; —কেউ সাধু ভাবে; দু-চারজন অবতার বলে ধরতে পারে।

    “যার যেমন পুঁজি—জিনিসের সেইরকম দর দেয়। একজন বাবু তার চাকরকে বললে, তুই এই হীরেটি বাজারে নিয়ে যা। আমায় বলবি, কে কি-রকম দর দেয়। আগে বেগুনওয়ালার কাছে নিয়ে যা। চাকরটি প্রথমে বেগুনওয়ালার কাছে গেল। সে নেড়ে চেড়ে দেখে বললে — ভাই, নয় সের বেগুন আমি দিতে পারি! চাকরটি বললে, ভাই আর একটু ওঠ, না হয় দশ শের দাও। সে বললে, আমি বাজার দরের চেয়ে বেশি বলে ফেলেছি; এতে তোমায় পোষায় তো দিয়ে যাও। চাকর তখন হাসতে হাসতে হীরেটি ফিরিয়ে নিয়ে বাবুর কাছে বললে, মহাশয়, (Ramakrishna) বেগুনওয়ালা নয় সের বেগুনের বেশি একটিও দেবে না। সে বললে, আমি বাজার দরের চেয়ে বেশি বলে ফেলেছি।

    বাবু হেসে বললে, আচ্ছা এবার কাপড়ওয়ালার কাছে নিয়ে যা। ও বেগুন নিয়ে থাকে, ও আর কতদূর বুঝবে! কাপড়ওয়ালার পুঁজি একটু বেশি, — দেখি ও কি বলে। চাকরটি কাপড়ওয়ালার কাছে বললে, ওহে এটি নেবে? কত দর দিতে পার? কাপড়ওয়ালা বললে, হাঁ জিনিসটা ভাল, এতে বেশ গয়না হতে পারে;—তা ভাই আমি নয়শো টাকা দিতে পারি। চাকরটি বললে, ভাই আর-একটু ওঠ, তাহলে ছেড়ে দিয়ে যাই; না হয় হাজার টাকাই দাও। কাপড়ওয়ালা বললে, ভাই, আর কিছু বলো না; আমি বাজার দরের চেয়ে বেশি বলে ফেলেছি; নয়শো টাকার বেশি একটি টাকাও আমি দিতে পারব না। চাকর ফিরিয়ে নিয়ে মনিবের কাছে হাসতে হাসতে ফিরে গেল আর বললে যে, কাপড়ওয়ালা বলেছে (Kathamrita) যে নশো টাকার বেশি একটি টাকাও সে দিতে পারবে না! আরও সে বলেছে, আমি বাজার দরের চেয়ে বেশি বলে ফেলেছি। তখন তার মনিব হাসতে হাসতে বললে, এইবার জহুরীর কাছে যাও—সে কি বলে দেখা যাক। চাকরটি জহুরীর কাছে এল। জহুরী একটু দেখেই একবারে বললে, একলাখ টাকা দেব।”

    ঈশ্বরকোটি ও জীবকোটি

    “সংসারে ধর্ম ধর্ম এরা করছে। যেমন একজন ঘরে আছে,—সব বন্ধ,—ছাদের ফুটো দিয়ে একটু আলো আসছে। মাতার উপর ছাদ থাকলে কি সূর্যকে দেখা যায়? একটু আলো এলে কি হবে? কামিনী-কাঞ্চন ছাদ! ছাদ তুলে না ফেললে কি সূর্যকে দেখা যায়! সংসারী লোক যেন ঘরের ভিতর বন্দী হয়ে আছে!

    “অবতারাদি ঈশ্বরকোটি। তারা ফাঁকা জায়গায় বেড়াচ্চে। তারা কখনও সংসারে বদ্ধ হয় না,— বন্দী হয় না। তাদের ‘আমি’ মোটা ‘আমি’ নয়—সংসারী লোকদের মতো। সংসারী লোকদের অহংকার, সংসারী লোকদের ‘আমি’—যেন চতুর্দিকে পাঁচিল, মাথার উপর ছাদ; — বাহিরে কোন জিনিস দেখা যায় না। অবতারাদির ‘আমি’ পাতলা ‘আমি’ (Ramakrishna)। এ ‘আমি’র ভিতর দিয়ে ঈশ্বরকে সর্বদা দেখা যায়। যেমন একজন লোক পাঁচিলের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে,—পাঁচিলের দুদিকেই অনন্ত মাঠ। সেই পাঁচিলের গায়ে যদি ফোকর থাকে পাঁচিলের ওধারে সব দেখা যায়। বড় ফোকর জলে আনাগোনাও হয়। অবতারাদির ‘আমি’ ওই ফোকরওয়ালা পাঁচিল। পাঁচিলের এধারে থাকলেও অনন্ত মাঠ দেখা যায়;—এর মানে, দেহধারণ করলেও তারা সর্বদা যোগেতেই থাকে! আবার ইচ্ছে হলে বড় ফোকরের ওধারে গিয়ে সমাধিস্থ হয়। আবার বড় ফোকর হলে আনাগোনা করতে পারে; সমাধিস্থ হলেও আবার নেমে আসতে পারে।”

    ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া অবতারতত্ত্ব শুনিতে লাগিলেন।

  • Ramakrishna 490: “যতক্ষণ ‘আমি’ টুকু থাকে ততক্ষণ ভেদবুদ্ধি, ‘আমি’ গেলে কি রইল তা কেউ জানতে পারে না”

    Ramakrishna 490: “যতক্ষণ ‘আমি’ টুকু থাকে ততক্ষণ ভেদবুদ্ধি, ‘আমি’ গেলে কি রইল তা কেউ জানতে পারে না”

    ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    সপ্তম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
    ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও অবতারতত্ত্ব

    শ্রীরামকৃষ্ণ (ত্রৈলোক্যের প্রতি)—অনন্ত ঢুকুতে চাও কেন? তোমাকে ছুঁলে কি তোমার সব শরীরটা ছুঁতে হবে? যদি গঙ্গাস্নান করি তা হলে হরিদ্বার থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত কি ছুঁয়ে যেতে হবে? ‘আমি গেলে ঘুচিবে জঞ্জাল’। যতক্ষণ ‘আমি’ টুকু থাকে ততক্ষণ ভেদবুদ্ধি। ‘আমি’ গেলে কি রইল তা কেউ জানতে পারে না,— মুখে বলতে (Kathamrita) পারে না। যা আছে তাই আছে! তখন খানিকটা এঁতে প্রকাশ হয়েছে আর বাদবাকিটা ওখানে প্রকাশ হয়েছে,—এ-সব মুখে বলা যায় না। সচ্চিদানন্দ সাগর!—তার ভিতর ‘আমি’ ঘট। যতক্ষণ ঘট ততক্ষণ যেন দুভাগ জল,—ঘটের ভিতরে একভাগ, বাহিরে এক ভাগ। ঘট ভেঙে গেলে—এক জল—তাও বলবার জো নাই!—কে বলবে?

    বিচারান্তে ঠাকুর ত্রৈলোক্যের সঙ্গে মিষ্টালাপ করিতেছেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—তুমি তো আনন্দে আছ?

    ত্রৈলোক্য—কই এখান থেকে উঠলেই আবার যেমন তেমনি হয়ে যাবে। এখন বেশ ঈশ্বরের উদ্দীপনা হচ্ছে।

    শ্রীরামকৃষ্ণ—জুতো পরে থাকলে, কাঁটা বনে আর তার ভয় নাই। ‘ঈশ্বর সত্য আর সব অনিত্য’ এই বোধ ধাকলে কামিনী-কাঞ্চনে আর ভয় নাই।

    ত্রৈলোক্যকে মিষ্টমুখ করাইতে বলরাম কক্ষান্তরে লইয়া গেলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ত্রৈলোক্যের ও তাঁহার মতালম্বী লোকদিগের ভক্তদের নিকট বর্ণনা করিতেছেন। রাত নয়টা হইল।

    অবতারকে কি সকলে চিনিতে পারে?

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna) গিরিশ, মণি ও অন্যান্য ভক্তদের প্রতি)—এর আকি জানো! একটা পাতকুয়ার ব্যাঙ কখনও পৃথিবী দেখে নাই; পাতকুয়াটি জানে; তাই বিশ্বাস করবে না যে, একটা পৃথিবী আছে। ভগবানের আনন্দের সন্ধান পায় নাই, তাই ‘সংসার, সংসার’ করছে।

    (গিরিশের প্রতি)—“ওদের সঙ্গে বকচো কেন? দুইই নিয়ে অছে। ভগবানের আনন্দের আস্বাদ না পেলে, সে আনন্দের কথা বুঝতে পারে না। পাঁচবছরের বালককে কি রমণসুখ বোঝানো যায়? বিষয়ীরা যে ঈশ্বর ঈশ্বর করে, সে শোনা কথা। যেমন খুড়ী জেঠিরা কোঁদল করে, তাদের কাছ থেকে বালকেরা শুনে শেখে আর বলে(Kathamrita), ‘আমার ঈশ্বর আছেন’, ‘তোর ঈশ্বরের দিব্য।

  • Ramakrishna 489: “প্রেমই ঈশ্বরের সারাংশ— যে মানুষ দিয়ে ঈশ্বরের প্রেম আসে তাকেই আমাদের দরকার”

    Ramakrishna 489: “প্রেমই ঈশ্বরের সারাংশ— যে মানুষ দিয়ে ঈশ্বরের প্রেম আসে তাকেই আমাদের দরকার”

    ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    সপ্তম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
    ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও অবতারতত্ত্ব

    একজন ভক্ত (ত্রৈলোক্যের প্রতি)—আপনার বইয়েতে দেখলাম আপনি অবতার মানেন না। চৈতন্যদেবের কথায় দেখলাম।

    ত্রৈললোক্য—তিনি নিজেই প্রতিবাদ করেছেন,—পুরীতে যখন অদ্বৈত ও অন্যান্য ভক্তেরা ‘তিনিই ভগবান’ (Ramakrishna) এই বলে গান করেছিলেন, গান শুনে চৈতন্যদেব ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঈশ্বরের অনন্ত ঐশ্বর্য। ইনি যেমন বলেন ভক্ত ঈশ্বরের বৈঠকখানা। তা বৈঠকখানা খুব সাজান বলে কি আর কিছু ঐশ্বর্য নাই?

    গিরিশ—ইনি বলেন, প্রেমই ঈশ্বরের সারাংশ—যে মানুষ দিয়ে ঈশ্বরের প্রেম আসে তাকেই আমাদের দরকার। ইনি বলেন, গরুর দুধ বাঁট দিয়ে আসে, আমাদের বাঁটের দরকার। গরুর শরীরে অন্য কিছু দরকার নাই; হাত, পা কি শিং।

    ত্রৈলোক্য—তাঁর প্রেমদুগ্ধ অনন্ত প্রণালী দিয়ে পড়ছে! তিনি যে অনন্তশক্তি!

    গিরিশ—ওই প্রেমের কাছে আর কোন শক্তি দাঁড়ায়?

    ত্রৈলোক্য—যাঁর শক্তি তিনি মনে (Kathamrita) করলে হয়! সবই ঈশ্বরের শক্তি।

    গিরিশ—আর সব তাঁর শক্তি বটে,—কিন্তু অবিদ্যা শক্তি।

    ত্রৈলোক্য—অবিদ্যা কি জিনিস! অবিদ্যা বলে একটা জিনিস আছে না কি? অবিদ্যা একটি অভাব। যেমন অন্ধকার আলোর অভাব। তাঁর প্রেম আমাদের পক্ষে খুব বটে। তাঁর বিন্দুতে আমাদের সিন্ধু! কিন্তু ওইটি যে শেষ, একথা বললে তাঁর সীমা করা হল।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (ত্রৈলোক্য ও অন্যানা ভক্তদের প্রতি)—হাঁ হাঁ, তা বটে। কিন্তু একটু মদ খেলেই আমাদের নেশা হয়। শুঁড়ির দোকানে কত মদ আছে সে হিসাবে আমাদের কাজ কি! অনন্ত শক্তির খপরে আমাদের কাজ কি?

    গিরিশ (ত্রৈলোক্যের প্রতি)—আপনি অবতার মানেন?

    ত্রৈলোক্য—ভক্ততেই ভগবান (Ramakrishna) অবতীর্ণ। অনন্ত শক্তির manifestation হয় না,—হতে পারে না!—কোন মানুষেই হতে পারে না।

    গিরিশ—ছেলেদের ‘ব্রহ্মগোপাল’ বলে সেবা (Kathamrita) করতে পারেন, মহাপুরুষকে ঈশ্বর বলে কি পূজা করতে পারা যায় না?

    শ্রীরামকৃষ্ণ (ত্রৈলোক্যের প্রতি)—অনন্ত ঢুকুতে চাও কেন? তোমাকে ছুঁলে কি তোমার সব শরীরটা ছুঁতে হবে? যদি গঙ্গাস্নান করি তা হলে হরিদ্বার থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত কি ছুঁয়ে যেতে হবে? ‘আমি গেলে ঘুচিবে জঞ্জাল’।

  • Ramakrishna 488: “‘কলঙ্ক সাগরে ভাসে, তবু কলঙ্ক না লাগে গায়, তখন পাঁকাল মাছের মতো থাকতে পারে”

    Ramakrishna 488: “‘কলঙ্ক সাগরে ভাসে, তবু কলঙ্ক না লাগে গায়, তখন পাঁকাল মাছের মতো থাকতে পারে”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
    শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিদ্যার সংসার—ঈশ্বরলাভের পর সংসা

    “চাতক তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে,—সাত সমুদ্র যত নদী পুষ্করিণী সব ভরপুর! তবু সে জল খাবে না! ছাতি ফেটে যাচ্ছে তবু খাবে না! স্বাতী নক্ষত্রের বৃষ্টির জলের জন্য হাঁ করে আছে! ‘বিনা স্বাতীকি জল সব ধূর!”

    দুআনা মদ ও দুদিক রাখা

    “বলে দুদিক রাখব। দুআনা মদ খেলে মানুষ দুদিক রাখতে চায়, আর খুব মদ খেলে কি আর দুদিক রাখা যায়!

    “ঈশ্বরের (Ramakrishna) আনন্দ পেলে আর কিছু ভাল লাগে না। তখন কামিনী-কাঞ্চনের কথা যেন বুকে বাজে। (ঠাকুর কীর্তনের সুরে বলিতেছেন) ‘আন্‌ লোকের আন্‌ কথা, কিছু ভাল তো লাগে না!’ তখন ঈশ্বরের জন্য পাগল হয়, টাকা-ফাকা কিছুই ভাল লাগে না!”

    ত্রৈলোক্য—সংসারে থাকতে গেলে টাকাও তো চাই, সঞ্চয়ও চাই (Kathamrita)। পাঁচটা দান-ধ্যান—

    শ্রীরামকৃষ্ণ—কি, আগে টাকা সঞ্চয় করে তবে ঈশ্বর! আর দান-ধ্যান-দয়া কত! নিজের মেয়ের বিয়েতে হাজার হাজার টাকা খরচ—আর পাশের বাড়িতে খেতে পাচ্ছে না। তাদের দুটি চাল দিতে কষ্ট হয়—অনেক হিসেব করে দিতে হয়। খেতে পাচ্ছে না লোকে,—তা আর কি হবে, ও শালারা মরুক বাঁচুক,—আমি আর আমার বাড়ির সকলে ভাল থাকলেই হল। মুখে বলে সর্বজীবে দয়া!

    ত্রৈলোক্য—সংসারে তো ভাল লোক আছে,—পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি, চৈতন্যদেবের ভক্ত। তিনি তো সংসারে ছিলেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—তার গলা পর্যন্ত মদ খাওয়া ছিল, যদি আর একটু খেত তা হলে আর সংসার করতে পারত না।

    ত্রৈলোক্য চুপ করিয়া রইলেন। মাস্টার গিরিশকে জনান্তিকে বলিতেছেন (Kathamrita), ‘তাহলে উনি যা লিখেছেন ঠিক নয়।’

    গিরিশ—তা হলে আপনি যা লিখেছেন ও-কথা ঠিক না?

    ত্রৈলোক্য—কেন, সংসারে ধর্ম হয় উনি কি মানেন না?

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—হয়,—কিন্তু জ্ঞানলাভ করে থাকতে হয়, ভগবানকে লাভ করে থাকতে হয়। তখন ‘কলঙ্ক সাগরে ভাসে, তবু কলঙ্ক না লাগে গায়।’ তখন পাঁকাল মাছের মতো থাকতে পারে। ঈশ্বরলাভের পর যে সংসার সে বিদ্যার সংসার। কামিনী-কাঞ্চন তাতে নাই, কেবল ভক্তি, ভক্ত আর ভগবান। আমারও মাগ আছে,—ঘরে ঘটিবাটিও আছে,—হরে প্যালাদের খাইয়ে দিই, আবার যখন হাবীর মা এরা আসে এদের জন্যও ভাবি।

  • Ramakrishna 487: “চাতক তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে,—সাত সমুদ্র যত নদী পুষ্করিণী সব ভরপুর! তবু সে জল খাবে না!”

    Ramakrishna 487: “চাতক তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে,—সাত সমুদ্র যত নদী পুষ্করিণী সব ভরপুর! তবু সে জল খাবে না!”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল

    শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিদ্যার সংসার—ঈশ্বরলাভের পর সংসার

    সন্ধ্যা হইল। বলরামের বৈঠকখানায় ও বারান্দায় আলো জ্বালা হইল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna) জগতের মাতাকে প্রণাম করিয়া, করে মূলমন্ত্র জপ করিয়া মধুর নাম করিতেছেন। ভক্তেরা চারিপার্শ্বে বসিয়া আছেন ও সেই মধুর নাম শুনিতেছেন। গিরিশ, মাস্টার, বলরাম, ত্রৈলোক্য ও অন্যান্য অনেক ভক্তরা এখনও আছেন। কেশবচরিত গ্রন্থে ঠাকুরের সংসার সম্বন্ধে মত পরিবর্তনের কথা যাহা লেখা আছে, ত্রৈলোক্যের সামনে সেই কথা উত্থাপন করিবেন, ভক্তেরা ঠিক করিয়াছেন। গিরিশ কথা (Kathamrita) আরম্ভ করিলেন।

    তিনি ত্রৈলোক্যকে বলিতেছেন, “আপনি যা লিখেছেন—যে সংসার সম্বন্ধে এঁর মত পরিবর্তন হয়েছে, তা বস্তুতঃ হয় নাই।”

    শ্রীরামকৃষ্ণ (ত্রৈলোক্য ও অন্যান্য ভক্তদের প্রতি)—এ-দিকের আনন্দ পেলে ওটা ভাল লাগে না, ভগবানের আনন্দলাভ করলে সংসার আলুনী বোধ হয়। শাল পেলে আর বনাত ভাল লাগে না!

    ত্রৈলোক্য—সংসার যারা করবে তাদের কথা আমি বলছি,—যারা ত্যাগী তাদের কথা বলছি না।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—ও-সব তোমাদের কি কথা!—যারা ‘সংসারে ধর্ম’ ‘সংসারে ধর্ম’ করছে, তারা একবার যদি ভগবানের আনন্দ পায় তাদের আর কিছু ভাল লাগে না, কাজের সব আঁট কমে যায়, ক্রমে যত আনন্দ বাড়ে কাজ আর করতে পারে না,— কেবল সেই আনন্দ খুঁজে খুঁজে বেড়ায়! ভগবানের আনন্দের কাছে বিষয়ানন্দ আর রমণানন্দ! একবার ভগবানের আনন্দের আস্বাদ পেলে সেই আনন্দের (Kathamrita) জন্য ছুটোছুটি করে বেড়ায়, তখন সংসার থাকে আর যায়।

    “চাতক তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে,—সাত সমুদ্র যত নদী পুষ্করিণী সব ভরপুর! তবু সে জল খাবে না! ছাতি ফেটে যাচ্ছে তবু খাবে না! স্বাতী নক্ষত্রের বৃষ্টির জলের জন্য হাঁ করে আছে! ‘বিনা স্বাতীকি জল সব ধূর!”

    দুআনা মদ ও দুদিক রাখা 

    “বলে দুদিক রাখব। দুআনা মদ খেলে মানুষ দুদিক রাখতে চায়, আর খুব মদ খেলে কি আর দুদিক রাখা যায়!

    “ঈশ্বরের আনন্দ পেলে আর কিছু ভাল লাগে না। তখন কামিনী-কাঞ্চনের কথা যেন বুকে বাজে। (ঠাকুর কীর্তনের সুরে বলিতেছেন) ‘আন্‌ লোকের আন্‌ কথা, কিছু ভাল তো লাগে না!’ তখন ঈশ্বরের জন্য পাগল হয়, টাকা-ফাকা কিছুই ভাল লাগে না!”

  • Ramakrishna 486: “জয় শচীনন্দন, গৌর গুণাকার, প্রেম-পরশমণি, ভাব-রস-সাগর”

    Ramakrishna 486: “জয় শচীনন্দন, গৌর গুণাকার, প্রেম-পরশমণি, ভাব-রস-সাগর”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    পঞ্চম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
    সংকীর্তনানন্দে ভক্তসঙ্গে

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—তুই বাপ-মাকে খুব ভক্তি করবি।—কিন্তু ঈশ্বরের পথে বাধা দিলে মানবিনি। খুব রোখ আনবি—শালার বাপ!

    ছোট নরেন—কে জানে, আমার কিছু ভয় হয় না।

    গিরিশ বাড়ি হইতে আবার আসিয়া উপস্থিত। ঠাকুর ত্রৈলোক্যের সহিত আলাপ করিয়া দিতেছেন; আর বলিতেছেন, ‘একটু আলাপ তোমরা কর।’ একটু আলাপের পর ত্রৈলোক্যকে বলিতেছেন, ‘সেই গানটি আর একবার,’—ত্রৈলোক্য গাইতেছেন (Kathamrita):

    ঝিঁঝিট খাম্বাজ—ঠুংরী

    জয় শচীনন্দন, গৌর গুণাকার, প্রেম-পরশমণি, ভাব-রস-সাগর।
    কিবা সুন্দর মুরতিমোহন আঁখিরঞ্জন কনকবরণ

    ঝিঁঝিট খাম্বাজ—ঠুংরী 

    জয় শচীনন্দন, গৌর গুণাকার, প্রেম-পরশমণি, ভাব-রস-সাগর।
    কিবা সুন্দর মুরতিমোহন আঁখিরঞ্জন কনকবরণ,
    কিবা মৃণালনিন্দিত, আজানুলম্বিত, প্রেম প্রসারিত, কোমল যুগল কর
    কিবা রুচির বদন-কমল, প্রেমরসে ঢল ঢল,
    চিকুর কুন্তল, চারু গণ্ডস্থল, হরিপ্রেমে বিহ্বল, অপরূপ মনোহর।
    মহাভাবে মণ্ডিত হরি রসে রঞ্জিত, আনন্দে পুলকিত অঙ্গ,
    প্রমত্ত মাতঙ্গ, সোনার গৌরাঙ্গ,
    আবেশে বিভোর অঙ্গ, অনুরাগে গরগর।
    হরিগুণগায়ক, প্রেমরস নায়ক,
    সাধু-হৃদিরঞ্জক, আলোকসামান্য, ভক্তিসিন্ধু শ্রীচৈতন্য,
    আহা! ‘ভাই’ বলি চণ্ডালে, প্রেমভরে লন কোলে,
    নাচেন দুবাহু তুলে, হরি বোল হরি বলে,
    অবিরল ঝরে জলে নয়নে নিরন্তর!
    ‘কোথা হরি প্রাণধন’ — বলে করে রোদন,
    মহাস্বেদ কম্পন, হুঙ্কার গর্জন,
    পুলকে রোমাঞ্চিত, শরীর কদম্বিত,
    ধুলায় বিলুণ্ঠিত সুন্দর কলেবর।
    হরি-লীলা-রস-নিকেতন, ভক্তিরস-প্রস্রবণ;
    দীনজনবান্ধব, বঙ্গের গৌরব, ধন্য ধন্য শ্রীচৈতন্য প্রেম শশধর।

    ‘গৌর হাসে কাঁদে নাচে গায়’—এই কথা শুনিয়া ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন,-একেবারে বাহ্যশূন্য!

    কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া—ত্রৈলোক্যকে অনুনয় বিনয় করিয়া বলিতেছেন, “একবার সেই গানটি!—কি দেখিলাম রে।”

    ত্রৈলোক্য গাইতেছেন:

    কি দেখিলাম রে, কেশব ভারতীর কুটিরে,
    অপরূপ জ্যোতি; গৌরাঙ্গ মূরতি, দুনয়নে প্রেম বহে শত ধারে।

    গান সমাপ্ত হইল। সন্ধ্যা হয়। ঠাকুর এখনও ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (রামের প্রতি)—বাজনা নাই! ভাল বাজনা থাকলে গান খুব জমে। (সহাস্যে) বলরামের আয়োজন কি জান,—বামুনের গোড্ডি (গরুটি) খাবে কম, দুধ দেবে হুড়হুড় করে! (সকলের হাস্য) বলরামের ভাব,—আপনারা গাও আপনারা বাজাও! (সকলের হাস্য)

  • Ramakrishna 485: “নদে টলমল টলমল করে গৌরপ্রেমের হিল্লোলে রে”

    Ramakrishna 485: “নদে টলমল টলমল করে গৌরপ্রেমের হিল্লোলে রে”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    পঞ্চম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
    সংকীর্তনানন্দে ভক্তসঙ্গে

    ঠাকুর ঘরের মধ্যে ফিরিয়া আসিয়া ত্রৈলোক্যকে বলিতেছেন,—একটু আনন্দময়ীর গান,—ত্রৈলোক্য গাইতেছেন:

       কত ভালবাস গো মা মানব সন্তানে,
    মনে হলে প্রেমধারা বহে দুনয়নে (গো মা)।
    তব পদে অপরাধী, আছি আমি জন্মাবধি,
    তবু চেয়ে মুখপানে প্রেমনয়নে, ডাকিছ মধুর বচনে,
    মনে হলে প্রেমধারা বহে দুনয়নে।
    তোমার প্রেমের ভার, বহিতে পারি না গো আর,
    প্রাণ উঠিছে কাঁদিয়া, হৃদয় ভেদিয়া, তব স্নেহ দরশনে,
    লইনু শরণ মা গো তব শ্রীচরণে (গো মা) ॥

    গান শুনিতে শুনিতে ছোট নরেন গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হইয়াছেন, যেন কাষ্ঠবৎ! ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, “দেখ, দেখ, কি গভীর ধ্যান! একেবারে বাহ্যশূন্য! (Kathamrita)”

    গান সমাপ্ত হইল। ঠাকুর (Ramakrishna) ত্রৈলোক্যকে এই গানটি গাইতে বলিলেন—‘দে মা পাগল করে, আর কাজ নাই জ্ঞান বিচারে।’

    রাম বলিতেছেন, কিছু হরিনাম হোক! ত্রৈলোক্য গাইতেছেন:

    মন একবার হরি বল হরি বল হরি বল।
    হরি হরি হরি বলে, ভবসিন্ধু পারে চল।

    মাস্টার আস্তে আস্তে বলিতেছেন, ‘গৌর-নিতাই তোমরা দুভাই।’

    ঠাকুরও (Ramakrishna) ওই গানটি গাইতে বলিতেছেন। ত্রৈলোক্য ও ভক্তেরা সকলে মিলিয়া গাইতেছেন:

    গৌর নিতাই তোমরা দুভাই পরম দয়াল হে প্রভু!

    ঠাকুরও যোগদান করিলেন। সমাপ্ত হইলে আর একটি ধরিলেন:

    যাদের হরি বলতে নয়ন ঝরে তারা দুভাই এসেছে রে।
    যারা মার খেয়ে প্রেম যাচে তারা তারা দুভাই এসেছে রে।
    যারা ব্রজের কানাই বলাই তারা তারা দুভাই এসেছে রে।
    যারা আচণ্ডালে কোল দেয় তারা তারা দুভাই এসেছে রে।

    ওই গানের সঙ্গে ঠাকুর আর একটা গান গাহিতেছেন:

    নদে টলমল টলমল করে গৌরপ্রেমের হিল্লোলে রে।

    ঠাকুর আবার ধরিলেন (Kathamrita):

    কে হরিবোল হরিবোল বলিয়ে যায়?
    যা রে মাধাই জেনে আয়।
    বুঝি গৌর যায় আর নিতাই যায় রে।
    যাদের সোনার নূপুর রাঙা পায়।
    যাদের নেড়া মাথা ছেঁড়া কাঁথা রে।
    যেন দেখি পাগলেরই প্রায়।

    ছোট নরেন বিদায় লইতেছেন —

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—তুই বাপ-মাকে খুব ভক্তি করবি।—কিন্তু ঈশ্বরের পথে বাধা দিলে মানবিনি। খুব রোখ আনবি—শালার বাপ!

    ছোট নরেন—কে জানে, আমার কিছু ভয় হয় না।

    গিরিশ বাড়ি হইতে আবার আসিয়া উপস্থিত। ঠাকুর ত্রৈলোক্যের সহিত আলাপ করিয়া দিতেছেন; আর বলিতেছেন, ‘একটু আলাপ তোমরা কর।’ একটু আলাপের পর ত্রৈলোক্যকে বলিতেছেন, ‘সেই গানটি আর একবার,’—ত্রৈলোক্য গাইতেছেন (Kathamrita):

    ঝিঁঝিট খাম্বাজ—ঠুংরী

       জয় শচীনন্দন, গৌর গুণাকার, প্রেম-পরশমণি, ভাব-রস-সাগর।
    কিবা সুন্দর মুরতিমোহন আঁখিরঞ্জন কনকবরণ

LinkedIn
Share