Tag: Ramakrishna Paramahansa

  • Ramakrishna 480: “যশোদা বললেন, মা, আর কি লব? তবে এই বল, যেন কায়মনোবাক্যে কৃষ্ণেরই সেবা করতে পারি”

    Ramakrishna 480: “যশোদা বললেন, মা, আর কি লব? তবে এই বল, যেন কায়মনোবাক্যে কৃষ্ণেরই সেবা করতে পারি”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    তৃতীয় পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
    সত্যকথা কলির তপস্যা — ঈশ্বরকোটি ও জীবকোটি

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—অবতার বা অবতারের অংশ, এদের বলে ঈশ্বরকোটি আর সাধারণ লোকদের বলে জীব বা জীবকোটি। যারা জীবকোটি তারা সাধনা করে ঈশ্বরলাভ করতে পারে; তারা সমাধিস্থ হয়ে আর ফেরে না।

    “যারা ঈশ্বরকোটি—তারা যেমন রাজার বেটা; সাততলার চাবি তাদের হাতে। তারা সাততলায় উঠে যায়, আবার ইচ্ছামতো নেমে আসতে পারে। জীবকোটি যেমন ছোট কর্মচারী, সাততলা বাড়ির খানিকটা যেতে পারে ওই পর্যন্ত।”

    জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয় 

    “জনক জ্ঞানী, সাধন করে জ্ঞানলাভ করেছিল; শুকদেব জ্ঞানের মূর্তি।”

    গিরিশ—আহা!

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna) সাধন করে শুকদেবের জ্ঞানলাভ করতে হয় নাই। নারদেরও শুকদেবের মতো ব্রহ্মজ্ঞান ছিল, কিন্তু ভক্তি নিয়ে ছিলেন—লোকশিক্ষার জন্য। প্রহ্লাদ কখনও সোঽহম্‌ ভাবে থাকতেন, কখনও দাসভাবে—সন্তানভাবে। হনুমানেরও ওই অবস্থা।

    “মনে করলে সকলেরই এই অবস্থা হয় না। কোনও বাঁশের বেশি খোল, কোনও বাঁশের ফুটো ছোট।”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    চতুর্থ পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল

    কামিনী-কাঞ্চন ও তীব্র বৈরাগ্য

    একজন ভক্ত—আপনার এ-সব ভাব নজিরের জন্য, তাহলে আমাদের কি করতে হবে?

    শ্রীরামকৃষ্ণ—ভগবানলাভ করতে হলে তীব্র বৈরাগ্য দরকার। যা ঈশ্বরের (Kathamrita) পথে বিরুদ্ধ বলে বোধ হবে তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করতে হয়। পরে হবে বলে ফেলে রাখা উচিত নয়। কামিনী-কাঞ্চন ঈশ্বরের পথে বিরোধী; ও-থেকে মন সরিয়ে নিতে হবে।

    “ঢিমে তেতালা হলে হবে না। একজন গামছা কাঁধে স্নান করতে যাচ্ছে। পরিবার বললে, তুমি কোন কাজের নও, বয়স বাড়ছে, এখন এ-সব ত্যাগ করতে পারলে না। আমাকে ছেড়ে তুমি একদিনও থাকতে পার না। কিন্তু অমুক কেমন ত্যাগী!

    স্বামী—কেন, সে কি করেছে?

    পরিবার—তার ষোলজন মাগ, সে এক-একজন করে তাদের ত্যাগ করছে। তুমি কখনও ত্যাগ করতে পারবে না।

    স্বামী—এক-একজন করে ত্যাগ! ওরে খেপী, সে ত্যাগ করতে পারবে না। যে ত্যাগ করে সে কি একটু একটু করে ত্যাগ করে!

    পরিবার—(সহাস্যে) — তবু তোমার চেয়ে ভাল।

    স্বামী—খেপী, তুই বুঝিস না। তার কর্ম নয়, আমিই ত্যাগ করতে পারব, এই দ্যাখ্‌ আমি চললুম!

    “এর নাম তীব্র বৈরাগ্য। যাই বিবেক এল তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করলে। গামছা কাঁধেই চলে গেল। সংসার গোছগাছ করতে এল না। বাড়ির দিকে একবার পেছন ফিরে চাইলেও না।

    “যে ত্যাগ করবে তার খুব মনের বল চাই। ডাকাত পড়ার ভাব। অ্যায়!!!—ডাকাতি করবার আগে যেমন ডাকাতেরা বলে মারো! লোটো! কাটো! (Kathamrita)

    “কি আর তোমরা করবে? তাঁতে ভক্তি, প্রেম লাভ করে দিন কাটানো। কৃষ্ণের অদর্শনে যশোদা পাগলের ন্যায় শ্রীমতীর কাছে গেলেন। শ্রীমতী তাঁর শোক দেখে আদ্যাশক্তিরূপে দেখা দিলেন। বললেন, মা, আমার কাছে বর নাও। যশোদা বললেন, মা, আর কি লব? তবে এই বল, যেন কায়মনোবাক্যে কৃষ্ণেরই (Ramakrishna) সেবা করতে পারি। এই চক্ষে তার ভক্তদর্শন,—যেখানে যেখানে তার লীলা, এই পা দিয়ে সেখানে যেতে পারি,—এই হাতে তার সেবা আর তার ভক্তসেবা,—সব ইন্দ্রিয়, যেন তারই কাজ করে।”

  • Ramakrishna 479: “‘সত্যকথা, অধীনতা, পরস্ত্রী মাতৃসমান—এইসে হরি না মিলে তুলসী ঝুট জবান্‌”

    Ramakrishna 479: “‘সত্যকথা, অধীনতা, পরস্ত্রী মাতৃসমান—এইসে হরি না মিলে তুলসী ঝুট জবান্‌”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    তৃতীয় পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
    সত্যকথা কলির তপস্যা — ঈশ্বরকোটি ও জীবকোটি

    একজন ভক্ত—মহাশয়, নব-হুল্লোল বলে এক মত বেরিয়েছে। শ্রীযুক্ত ললিত চাটুজ্যে তার ভিতর আছেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—নানা মত আছে। মত পথ। কিন্তু সব্বাই মনে করে, আমার মতই ঠিক — আমার ঘড়ি ঠিক চলছে।

    গিরিশ (মাস্টারের প্রতি)—পোপ কি বলেন? It is with our judgements ইত্যাদি

    শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—এর মানে কি গা?

    মাস্টার—সব্বাই মনে করে, আমার ঘড়ি ঠিক যাচ্ছে, কিন্তু ঘড়িগুলো পরস্পর মেলে না।

    শ্রীরামকৃষ্ণ—তবে অন্য ঘড়ি যত ভুল হউক না, সূর্য কিন্তু ঠিক যাচ্ছে। সেই সূর্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হয়।

    একজন ভক্ত—অমুকবাবু বড় মিথ্যা কথা কয় (Kathamrita)।

    শ্রীরামকৃষ্ণ—সত্যকথা কলির তপস্যা। কলিতে অন্য তপস্যা কঠিন। সত্যে থাকলে ভগবানকে পাওয়া যায়। তুলসীদাস বলেছে, ‘সত্যকথা, অধীনতা, পরস্ত্রী মাতৃসমান—এইসে হরি না মিলে তুলসী ঝুট জবান্‌।’

    “কেশব সেন বাপের ধার মেনেছিল, অন্য লোক হলে কখনও মানতো না, একে লেখাপড়া নাই। জোড়াসাঁকোর দেবেন্দ্রের সমাজে গিয়ে দেখলাম, কেশব সেন বেদীতে বসে ধ্যান করছে। তখন ছোকরা বয়েস। আমি সেজোবাবুকে বললাম, যতগুলি ধ্যান করছে এই ছোকরার ফতা (ফাত্‌না) ডুবেছে,—বড়শির কাছে মাছ এসে ঘুরছে।

    “একজন—তার নাম করবো না—সে দশহাজার টাকার জন্য আদালতে মিথ্যা কথা কয়েছিল। জিতবে বলে আমাকে দিয়ে মা-কালীকে অর্ঘ্য দেওয়ালে। আমি বালকবুদ্ধিতে অর্ঘ্য দিলুম! বলে, বাবা এই অর্ঘটি মাকে দাও তো!”

    ভক্ত—আচ্ছা লোক!

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—কিন্তু এমনি বিশ্বাস আমি দিলেই মা শুনবেন!

    ললিতবাবুর কথায় ঠাকুর বলিতেছেন —

    “অহংকার কি যায় গা! দুই-এক জনের দেখতে পাওয়া যায় না। বলরামের অহংকার নাই। আর এঁর নাই!—অন্য লোক হলে কত টেরী, তমো হত—বিদ্যার অহংকার হতো। মোটা বামুনের এখনও একটু একটু আছে! (মাস্টারের প্রতি) মহিম চক্রবর্তী অনেক পড়েছে, না?”

    মাস্টার—আজ্ঞা হাঁ, অনেক বই পড়েছেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—তার সঙ্গে গিরিশ ঘোষের একবার আলাপ হয়। তাহলে একটু বিচার হয়।

    গিরিশ (সহাস্যে)—তিনি বুঝি বলেন (Kathamrita) সাধনা করলে শ্রীকৃষ্ণের মতো সব্বাই হতে পারে?

    শ্রীরামকৃষ্ণ—ঠিক তা নয়,—তবে আভাসটা ওইরকম।

    ভক্ত—আজ্ঞা, শ্রীকৃষ্ণের মতো সব্বাই কি হতে পারে?

  • Ramakrishna 478: “মেয়ে-মানুষের কি মোহিনী শক্তি, অবিদ্যারূপিণী মেয়েদের, পুরুষগুলোকে যেন বোকা অপদার্থ করে রেখে দেয়”

    Ramakrishna 478: “মেয়ে-মানুষের কি মোহিনী শক্তি, অবিদ্যারূপিণী মেয়েদের, পুরুষগুলোকে যেন বোকা অপদার্থ করে রেখে দেয়”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল

    পূর্বকথা—শ্রীরামকৃষ্ণের মহাভাব—ব্রাহ্মণীর সেবা

    “কামিনী-কাঞ্চনই সংসার—ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়।”

    গিরিশ—কামিনী-কাঞ্চন ছাড়ে কই?

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—তাঁকে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা কর, বিবেকের জন্য প্রার্থনা কর। ঈশ্বরই সত্য আর সব অনিত্য—এরই নাম বিবেক! জল-ছাঁকা দিয়ে জল ছেঁকে নিতে হয়। ময়লাটা একদিকে পড়ে-ভাল জল একদিকে পড়ে, বিবেকরূপ জল-ছাঁকা আরোপ করো। তোমরা তাঁকে জেনে সংসার করো। এরই নাম বিদ্যার সংসার।

    “দেখ না, মেয়ে-মানুষের কি মোহিনী শক্তি, অবিদ্যারূপিণী মেয়েদের। পুরুষগুলোকে যেন বোকা অপদার্থ করে রেখে দেয়। যখনই দেখি স্ত্রী-পুরুষ একসঙ্গে বসে আছে, তখন বলি (Kathamrita), আহা! এরা গেছে। (মাস্টারের দিকে তাকাইয়া)—হারু এমন সুন্দর ছেলে, তাকে পেতনীতে পেয়েছে! — ‘ওরে হারু কোথা গেল’, ‘ওরে হারু কোথা গেল’। সব্বাই গিয়ে দেখে হারু বটতলায় চুপ করে বসে আছে। সে রূপ নাই, সে তেজ নাই, সে আনন্দ নাই! বটগাছের পেতনীতে হারুকে পেয়েছে।

    “স্ত্রী যদি বলে ‘যাও তো একবার’—অমনি উঠে দাঁড়ায়, ‘বসো তো’—আমনি বসে পড়ে।

    “একজন উমেদার বড়বাবুর কাছে আনাগোনা করে হায়রান হয়েছে। কর্ম আর হয় না। আফিসের বড়বাবু। তিনি বলেন, এখন খালি নাই, মাঝে মাঝে এসে দেখা করো। এইরূপে কতকাল কেটে গেল-উমেদার হতাশ হয়ে গেল। সে একজন বন্ধুর কাছে দুঃখ করছে। বন্ধু বললে তোর যেমন বুদ্ধি।—ওটার কাছে আনাগোনা করে পায়ের বাঁধন ছেঁড়া কেন? তুই গোলাপকে ধর, কালই তোর কর্ম হবে। উমেদার বললে, বটে!—আমি এক্ষণি চললুম। গোলাপ বড়বাবুর রাঁড়। উমেদার দেখা করে বললে, মা, তুমি এটি না করলে হবে না—আমি মহাবিপদে পড়েছি। ব্রাহ্মণের ছেলে (Kathamrita) আর কোথায় যাই! মা, অনেকদিন কাজকর্ম নাই, ছেলেপুলে না খেতে পেয়ে মারা যায়। তুমি একটি কথা বলে দিলেই আমার একটি কাজ হয়। গোলাপ ব্রাহ্মণের ছেলেকে বললে, বাছা, কাকে বললে হয়? আর ভাবতে লাগল, আহা, ব্রাহ্মণের ছেলে বড় কষ্ট পাচ্ছে! উমেদার বললে, বড়বাবুকে একটি কথা বললে আমার নিশ্চয় একটা কর্ম হয়। গোলাপ বললে, আমি আজই বড়বাবুকে বলে ঠিক করে রাখব। তার পরদিন সকালে উমেদারের কাছে একটি লোক গিয়ে উপস্থিত; সে বললে, তুমি আজ থেকেই বড়বাবুর আফিসে বেরুবে। বড়বাবু সাহেবকে বললে, ‘এ ব্যক্তি বড় উপযুক্ত লোক। একে নিযুক্ত করা হয়েছে, এর দ্বারা আফিসের বিশেষ উপকার হবে।’

    “এই কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে সকলে ভুলে আছে। আমার কিন্তু ও-সব ভাল লাগে না—মাইরি বলছি, ঈশ্বর (Ramakrishna) বই আর কিছুই জানি না।”

  • Ramakrishna 477: “মহাভাব ঈশ্বরের ভাব এই দেহ-মনকে তোলপাড় করে দেয়”

    Ramakrishna 477: “মহাভাব ঈশ্বরের ভাব এই দেহ-মনকে তোলপাড় করে দেয়”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল

    পূর্বকথা—শ্রীরামকৃষ্ণের মহাভাব—ব্রাহ্মণীর সেবা

    গিরিশ, মাস্টার প্রভৃতিকে সম্বোধন করিয়া ঠাকুর নিজের মহাভাবের অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna) ভক্তদের প্রতি—সে অবস্থার পরে আনন্দও যেমন, আগে যন্ত্রণাও তেমনি। মহাভাব ঈশ্বরের ভাব (Kathamrita)— এই দেহ-মনকে তোলপাড় করে দেয়! যেন একটা বড় হাতি কুঁড়ে ঘরে ঢুকেছে। ঘর তোলপাড়! হয়তো ভেঙেচুড়ে যায়!

    “ঈশ্বরের বিরহ-অগ্নি সামান্য নয়। রূপসনাতন যে গাছের তলায় বসে থাকতেন ওই অবস্থা হলে এইরকম আছে যে, গাছের পাতা ঝলসা-পোড়া হয়ে যেত! আমি এই অবস্থায় তিনদিন অজ্ঞান হয়ে ছিলাম। নড়তে-চড়তে পারতাম না, এক জায়গায় পড়েছিলাম। হুঁশ হলে বামনী আমায় ঘরে স্নান করাতে নিয়ে গেল। কিন্তু হাত দিয়ে গা ছোঁবার জো ছিল না। গা মোটা চাদর দিয়ে ঢাকা। বামনী সেই চাদরের উপর হাত দিয়ে আমায় ধরে নিয়ে গিছল। গায়ে যে সব মাটি লেগেছিল, পুড়ে গিছল!

    “যখন সেই অবস্থা আসত শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে যেন ফাল চালিয়ে যেত! ‘প্রাণ যায়, প্রাণ যায়’ এই করতাম। কিন্তু তারপরে খুব আনন্দ!”

    ভক্তেরা এই মহাভাবের অবস্থা বর্ণনা অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি)—এতদূর তোমাদের দরকার নাই। আমার ভাব কেবল নজিরের জন্য। তোমরা পাঁচটা নিয়ে আছ, আমি একটা নিয়ে আছি। আমার ঈশ্বর বই কিছু ভাল লাগে না। তাঁর ইচ্ছে। (সহাস্যে) একডেলে গাছও আছে আবার পাঁচডেলে গাছও আছে। (সহলের হাস্য)

    “আমার অবস্থা নজিরের জন্য। তোমরা সংসার করো, অনাসক্ত হয়ে। গায়ে কাদা লাগবে কিন্তু ঝেড়ে ফেলবে, পাঁকাল মাছের মতো। কলঙ্কসাগরে সাঁতার দেবে—তবু গায়ে কলঙ্ক লাগবে না।”

    গিরিশ (সহাস্যে)—আপনারও তো বিয়ে আছে। (হাস্য)

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna) সহাস্য—সংস্কারের জন্য বিয়ে করতে হয়, কিন্তু সংসার আর কেমন করে হবে! গলায় পৈতে পরিয়ে দেয় আবার খুলে খুলে পড়ে যায় — সামলাতে পারি নাই। একমতে আছে, শুকদেবের বিয়ে হয়েছিল (Kathamrita)— সংস্কারের জন্য। একটি কন্যাও নাকি হয়েছিল। (সকলের হাস্য)

  • Ramakrishna 476: “দেশ কাল বোধ চলিয়া যাইতেছে, অতি কষ্টে ভাব সম্বরণ করিতে চেষ্টা করিতেছেন”

    Ramakrishna 476: “দেশ কাল বোধ চলিয়া যাইতেছে, অতি কষ্টে ভাব সম্বরণ করিতে চেষ্টা করিতেছেন”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
    ঠাকুরের নিজ মুখে কথিত সাধনা বিবরণ

    ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বালকভাব ও ভাবাবেশ 

    অষ্টসিদ্ধি ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ—গুরুগিরি ও বেশ্যাবৃত্তি

    শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনায় প্রলোভন (Temptation)—ব্রহ্মজ্ঞান ও অভেদবুদ্ধি  শ্রীরামকৃষ্ণ ও মুসলমান ধর্ম

    (গিরিশ, মাস্টার প্রভৃতির প্রতি)—“আমার বালক স্বভাব। হৃদে বললে, মামা, মাকে কিছু শক্তির (Ramakrishna)  কথা বলো,—অমনি মাকে বলতে চললাম! এমনি অবস্থায় রেখেছে যে, যে ব্যক্তি কাছে থাকবে তার কথা শুনতে হয়। ছোট ছেলের যেমন কাছে লোক না থাকলে অন্ধকার দেখে—আমারও সেইরূপ হত! হৃদে কাছে না থাকলে প্রাণ যায় যায় হত! ওই দেখো ওই ভাবটা আসছে!— কথা (Kathamrita) কইতে কইতে উদ্দীপন হয়।”

    এই কথা বলিতে (Kathamrita) বলিতে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। দেশ কাল বোধ চলিয়া যাইতেছে। অতি কষ্টে ভাব সম্বরণ করিতে চেষ্টা করিতেছেন। ভাবে বলিতেছেন, “এখনও তোমাদের দেখছি,— কিন্তু বোধ হচ্ছে যেন চিরকাল তোমরা বসে আছ, কখন এসেছ, কোথায় এসেছ এ-সব কিছু মনে নাই।”

    ঠাকুর কিয়ৎকাল প্রকৃতিস্থ হইয়া বলিতেছেন, “জল খাব।” সমাধিভঙ্গের পর মন নামাইবার জন্য ঠাকুর এই কথা প্রায় বলিয়া থাকেন। গিরিশ নূতন আসিতেছেন, জানেন না তাই জল আনিতে উদ্যত হইলেন। ঠাকুর বারণ করিতেছেন আর বলিতেছেন, “না বাপু, এখন খেতে পারব না।” ঠাকুর ও ভক্তগণ ক্ষণকাল চুপ করিয়া আছেন। এইবার ঠাকুর কথা (Kathamrita) কহিতেছেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Kathamrita) মাস্টারের প্রতি—হ্যাঁগা, আমার কি অপরাধ হল? এ-সব (গুহ্য) কথা বলা?

    মাস্টার কি বলিবেন চুপ করিয়া আছেন। তখন ঠাকুর আবার বলিতেছেন, “না, অপরাধ কেন হবে, আমি লোকের বিশ্বাসের জন্য বলেছি।” কিয়ৎ পরে যেন কত অনুনয় করিয়া বলিতেছেন, “ওদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে?” (অর্থাৎ পূর্ণের সঙ্গে)

    মাস্টার (সঙ্কুচিতভাবে)—আজ্ঞে, এক্ষণই খবর পাঠাব।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (Kathamrita) সাগ্রহে—ওইখানে খুঁটে মিলছে।

    ঠাকুর কি বলিতেছেন যে অন্তরঙ্গ ভক্তদের ভিতর পূর্ণ শেষ ভক্ত, তাঁহার পর প্রায় কেহ নাই?

  • Ramakrishna 475: “মার সেই রূপ—সেই ভুবনমোহন রূপ— কৃষ্ণময়ীর রূপ!—কিন্তু চাউনীতে যেন জগৎটা নড়ছে!”

    Ramakrishna 475: “মার সেই রূপ—সেই ভুবনমোহন রূপ— কৃষ্ণময়ীর রূপ!—কিন্তু চাউনীতে যেন জগৎটা নড়ছে!”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
    ঠাকুরের নিজ মুখে কথিত সাধনা বিবরণ

     

    অষ্টসিদ্ধি ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ—গুরুগিরি ও বেশ্যাবৃত্তি 

    শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনায় প্রলোভন (Temptation)—ব্রহ্মজ্ঞান ও অভেদবুদ্ধি 
    শ্রীরামকৃষ্ণ ও মুসলমান ধর্ম

    “সাধনার সময় ধ্যান করতে করতে আমি আরও কত কি দেখতাম। বেলতলায় ধ্যান করছি, পাপপুরুষ এসে কতরকম লোভ দেখাতে লাগল। লড়ায়ে গোরার রূপ ধরে এসেছিল। টাকা, মান, রমণ সুখ নানারকম শক্তি, এই সব দিতে চাইলে। আমি মাকে ডাকতে লাগলাম। বড় গুহ্যকথা। মা দেখা দিলেন, তখন আমি বললাম, মা ওকে কেটে ফেলো। মার সেই রূপ—সেই ভুবনমোহন রূপ—মনে পড়ছে। কৃষ্ণময়ীর রূপ!—কিন্তু চাউনীতে যেন জগৎটা নড়ছে!”

    ঠাকুর (Ramakrishna) চুপ করিলেন। ঠাকুর আবার বলিতেছেন—“আরও কত কি বলতে দেয় না!—মুখ যেন কে আটকে দেয়!

    “সজনে তুলসী এক বোধ হত! ভেদ-বুদ্ধি দূর করে দিলেন। বটতলায় ধ্যান করছি, দেখালে একজন দেড়ে মুসলমান (মোহম্মদ) সানকি করে ভাত নিয়ে সামনে এল। সানকি থেকে ম্লেচ্ছদের খাইয়ে আমাকে দুটি দিয়ে গেল। মা দেখালেন, এক বই দুই নাই। সচ্চিদানন্দই নানারূপ ধরে রয়েছেন। তিনিই জীবজগৎ সমস্তই হয়েছেন। তিনিই অন্ন (Kathamrita) হয়েছেন।”

    ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বালকভাব ও ভাবাবেশ

    (গিরিশ, মাস্টার প্রভৃতির প্রতি)—“আমার বালক স্বভাব। হৃদে বললে, মামা, মাকে কিছু শক্তির (Ramakrishna)  কথা বলো,—অমনি মাকে বলতে চললাম! এমনি অবস্থায় রেখেছে যে, যে ব্যক্তি কাছে থাকবে তার কথা শুনতে হয়। ছোট ছেলের যেমন কাছে লোক না থাকলে অন্ধকার দেখে—আমারও সেইরূপ হত! হৃদে কাছে না থাকলে প্রাণ যায় যায় হত! ওই দেখো ওই ভাবটা আসছে!— কথা (Kathamrita) কইতে কইতে উদ্দীপন হয়।”

  • Ramakrishna 474: “যারা শুদ্ধভক্ত তারা ঈশ্বরের পাদপদ্ম ছাড়া কিছুই চায় না”

    Ramakrishna 474: “যারা শুদ্ধভক্ত তারা ঈশ্বরের পাদপদ্ম ছাড়া কিছুই চায় না”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
    ঠাকুরের নিজ মুখে কথিত সাধনা বিবরণ

    অষ্টসিদ্ধি ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ—গুরুগিরি ও বেশ্যাবৃত্তি 

    শ্রীযুক্ত গিরিশ ঠাকুরের নাম করিয়া ব্যারাম ভাল করিব—এই কথা মাঝে মাঝে বলিতেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশ প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি)—যারা হীনবুদ্ধি তারা সিদ্ধাই চায়। ব্যারাম ভাল করা, মোকদ্দমা জিতানো, জলে হেঁটে চলে যাওয়া—এই সব। যারা শুদ্ধভক্ত তারা ঈশ্বরের (Ramakrishna) পাদপদ্ম ছাড়া কিছুই চায় না। হৃদে একদিন বললে ‘মামা! মার কাছে কিছু শক্তি চাও, কিছু সিদ্ধাই চাও।’ আমার বালকের স্বভাব—কালীঘরে জপ করবার সময় মাকে বললাম, মা হৃদে বলছে কিছু সিদ্ধাই চাইতে। অমনি দেখিয়ে দিলে সামনে এসে পেছন ফিরে উবু হয়ে বসলো—একজন বুড়ো বেশ্যা, চল্লিশ বছর বয়স—ধামা পোঁদ—কালাপেড়ে কাপড় পরা—পড় পড় করে হাগছে! মা দেখিয়ে দিলেন যে, সিদ্ধাই এই বুড়ো বেশ্যার বিষ্ঠা! তখন হৃদেকে গিয়ে বকলাম আর বললাম, তুই (Kathamrita) কেন আমায় এরূপ কথা শিখিয়ে দিলি। তোর জন্যই তো আমার এরূপ হল!

    “যাদের একটু সিদ্ধাই থাকে তাদের প্রতিষ্ঠা, লোকমান্য এই সব হয়। অনেকের ইচ্ছা হয় গুরুগিরি করি—পাঁচজনে গণে মানে—শিষ্য-সেবক হয়; লোকে বলবে, গুরুচরণের ভাইয়ের আজকাল বেশ সময়—কত লোক আসছে যাচ্ছে—শিষ্য-সেবক অনেক হয়েছে—ঘরে জিনিসপত্র থইথই করছে!—কত জিনিস কত লোক এনে দিচ্ছে—সে যদি মনে করে—তার এমন শক্তি হয়েছে যে, কত লোককে খাওয়াতে পারে।

    “গুরুগিরি (Ramakrishna) বেশ্যাগিরির মতো।—ছার টাকা-কড়ি, লোকমান্য হওয়া, শরীরের সেবা, এই সবের জন্য আপনাকে বিক্রি করা। যে শরীর মন আত্মার দ্বারা ঈশ্বরকে (Kathamrita) লাভ করা যায়, সেই শরীর মন আত্মাকে সামান্য জিনিসের জন্য এরূপ করে রাখা ভাল নয়। একজন বলেছিল, সাবির এখন খুব সময়—এখন তার বেশ হয়েছে—একখানা ঘরভাড়া নিয়েছে—ঘুঁটে রে, গোবর রে, তক্তপোশ, দুখানা বাসন হয়েছে, বিছানা, মাদুর, তাকিয়া—কতলোক বশীভূত, যাচ্ছে আসছে! অর্থাৎ সাবি এখন বেশ্যা হয়েছে তাই সুখ ধরে না! আগে সে ভদ্রলোকের (Ramakrishna) বাড়ির দাসী ছিল, এখন বেশ্যা হয়েছে! সামান্য জিনিসের জন্য নিজের সর্বনাশ!”

  • Ramakrishna 473: “ধ্যানে এইরূপ একাগ্রতা হয়, অন্য কিছু দেখা যায় না শোনাও যায় না”

    Ramakrishna 473: “ধ্যানে এইরূপ একাগ্রতা হয়, অন্য কিছু দেখা যায় না শোনাও যায় না”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
    ঠাকুরের নিজ মুখে কথিত সাধনা বিবরণ

     

    “একজন একলা একটি পুকুরের ধারে মাছ ধরছে। অনেকক্ষণ পরে ফাতনাটা নড়তে লাগল, মাঝে মাঝে কাত হতে লাগল। সে তখন ছিপ হাতে করে টান মারবার উদ্যোগ করছে। এমন সময় একজন পথিক কাছে এসে জিজ্ঞাসা করছে, মহাশয় (Kathamrita), অমুক বাঁড়ুজ্যেদের বাড়ি কোথায় বলতে পারেন? সে ব্যক্তির হুঁশ নাই। তার হাত কাঁপছে, কেবল ফাতনার দিকে দৃষ্টি। তখন পথিক বিরক্ত হয়ে চলে গেল। সে অনেক দূরে চলে গেছে, এমন সময় ফাতনাটা ডুবে গেল, আর ও ব্যক্তি টান মেরে মাছটাকে আড়ায় তুললে। তখন গামছা দিয়ে মুখ পুঁছে, চিৎকার করে পথিককে ডাকছে—ওহে—শোনা—শোনো! পথিক ফিরতে চায় না, অনেক ডাকাডাকির পর ফিরল। এসে বলছে, কেন মহাশয় (Ramakrishna), আবার ডাকছ কেন? তখন সে বললে, তুমি আমায় কি বলছিলে? পথিক বললে, তখন অতবার করে জিজ্ঞাসা করলুম — আর এখন বলছো কি বললে! সে বললে, তখন যে ফাতনা ডুবছিল, তাই আমি কিছুই শুনতে পাই নাই।

    “ধ্যানে এইরূপ একাগ্রতা হয়, অন্য কিছু দেখা যায় না শোনাও যায় না। স্পর্শবোধ পর্যন্ত হয় না। সাপ গায়ের উপর দিয়ে চলে যায়, জানতে পারে না। যে ধ্যান করে সেও বুঝতে পারে না—সাপটাও জানতে পারে না।

    “গভীর ধ্যানে ইন্দ্রিয়ের (Ramakrishna) সব কাজ বন্ধ হয়ে যায়। মন বহির্মুখ থাকে না — যেন বার-বাড়িতে কপাট পড়লো। ইন্দ্রিয়ের পাঁচটি বিষয়! রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ—বাহিরে পড়ে থাকবে।

    “ধ্যানের সময় প্রথম প্রথম ইন্দ্রিয়ের বিষয় সকল সামনে আসে—গভীর ধ্যানে সে সকল আর আসে না—বাহিরে পড়ে থাকে। ধ্যান করতে করতে আমার কত কি দর্শন হত। প্রতক্ষ দেখলাম—সামনে টাকার কাঁড়ি, শাল, একথালা সন্দেশ, দুটো মেয়ে, তাদের ফাঁদী নথ। মনকে জিজ্ঞাসা করলাম আবার—মন তুই কি চাস? মন বললে, ‘না, কিছুই চাই না। ঈশ্বরের পাদপদ্ম ছাড়া আর কিছুই চাই না।’ মেয়েদের ভিতর-বার সমস্ত দেখতে পেলাম (Kathamrita)—যেমন, কাচের ঘরে সমস্ত জিনিস বার থেকে দেখা যায়! তাদের ভিতরে দেখলাম—নাড়ীভুঁড়ি, রক্ত, বিষ্ঠা, কৃমি, কফ, নাল, প্রস্রাব এই সব!”

  • Ramakrishna 472: “জয় কালী! কি, তুই দেখা দিবিনি! এই গলায় ছুরি দেব যদি দেখা না দিস”

    Ramakrishna 472: “জয় কালী! কি, তুই দেখা দিবিনি! এই গলায় ছুরি দেব যদি দেখা না দিস”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল

    ঠাকুরের নিজ মুখে কথিত সাধনা বিবরণ

    “যখন লীলায় মন নেমে আসত কখনও সীতারামকে রাতদিন চিন্তা করতাম। আর সীতারামের রূপ সর্বদা দর্শন হত—রামলালকে (রামের অষ্টধাতু নির্মিত ছোট বিগ্রহ) নিয়ে সর্বদা বেড়াতাম, কখনও খাওয়াতাম। আবার কখনও রাধাকৃষ্ণের ভাবে থাকতাম। ওই রূপ সর্বদা দর্শন (Kathamrita) হত। আবার কখনও গৌরাঙ্গের ভাবে থাকতাম, দুই ভাবের মিলন—পুরুষ ও প্রকৃতি ভাবের মিলন। এ অবস্থায় সর্বদাই গৌরাঙ্গের রূপ দর্শন হত। আবার অবস্থা বদলে গেল! সজনে তুলসী সব এক বোধ হতে লাগল। ঈশ্বরীয় (Ramakrishna) রূপ আর ভাল লাগল না। বললাম, ‘কিন্তু তোমাদের বিচ্ছেদ আছে।’ তখন তাদের তলায় রাখলাম। ঘরে যত ঈশ্বরীয় পট বা ছবি ছিল সব খুলে ফেললাম। কেবল সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ সেই আদি পুরুষকে চিন্তা করতে লাগলাম। নিজে দাসীভাবে রইলুম—পুরুষের দাসী।

    “আমি সবরকম সাধন করেছি। সাধনা তিন প্রকার—সাত্ত্বিক, রাজসিক, তামসিক। সাত্ত্বিক সাধনায় তাঁকে ব্যাকুল হয়ে ডাকে বা তাঁর নামটি শুদ্ধ নিয়ে থাকে। আর কোন ফলাকাঙ্খা নাই। রাজসিক সাধনে নানারকম প্রক্রিয়া—এতবার পুরশ্চরণ করতে হবে, এত তীর্থ করতে হবে, পঞ্চতপা করতে হবে; ষোড়শোপচারে পূজা করতে হবে ইত্যাদি। তামসিক সাধন — তমোগুণ আশ্রয় করে সাধন। জয় কালী (Kathamrita)! কি, তুই দেখা দিবিনি! এই গলায় ছুরি দেব যদি দেখা না দিস। এ সাধনায় শুদ্ধাচার নাই—যেমন তন্ত্রের সাধন।

    “সে অবস্থায় (সাধনার অবস্থায়) অদ্ভুত সব দর্শন হত, আত্মার রমণ প্রত্যক্ষ দেখলাম। আমার মতো রূপ একজন আমার শরীরের ভিতর প্রবেশ করলে! আর ষট্‌পদ্মের প্রত্যেক পদ্মের সঙ্গে রমণ করতে লাগল। ষট্‌পদ্ম মুদিত হয়েছিল—টক টক করে রমণ করে আর একটি পদ্ম প্রস্ফুটিত হয়—আর ঊর্ধ্বমুখ হয়ে যায়! এইরূপে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞাপদ্ম (Ramakrishna), সহস্রার সকল পদ্মগুলি ফুটে উঠল। আর নিচে মুখ ছিল ঊর্ধ্বমুখ হল, প্রত্যক্ষ দেখলাম।”

    ধ্যানযোগ সাধনা—‘নিবাত নিষ্কম্পমিবপ্রদীপম্‌’ 

    “সাধনার সময় আমি ধ্যান করতে করতে আরোপ করতাম প্রদীপের শিখা—যখন হাওয়া নাই, একটুও নড়ে না—তার আরোপ করতাম।

    “গভীর ধ্যানে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়। একজন ব্যাধ পাখি মারবার জন্য তাগ করছে। কাছ দিয়ে বর চলে যাচ্ছে, সঙ্গে বরযাত্রীরা, কত রোশনাই, বাজনা, গাড়ি, ঘোড়া—কতক্ষণ ধরে কাছ দিয়ে চলে গেল। ব্যাধের কিন্তু হুঁশ নাই। সে জানতে পারলো না যে কাছ দিয়ে বর চলে গেল।

  • Ramakrishna ৪৭১: “ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন না রাখি শূলের বাড়ি আমায় মারবে”

    Ramakrishna ৪৭১: “ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন না রাখি শূলের বাড়ি আমায় মারবে”

    ৪৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    ১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল

    ঠাকুরের নিজ মুখে কথিত সাধনা বিবরণ

    ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna) কলিকাতায় শ্রীযুক্ত বলরামের বৈঠকখানায় ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। গিরিশ, মাস্টার, বলরাম—ক্রমে ছোট নরেন, পল্টু, দ্বিজ, পূর্ণ, মহেন্দ্র মুখুজ্জে ইত্যাদি—অনেক ভক্ত উপস্থিত আছেন। ক্রমে ব্রাহ্মসমাজের শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য সান্যাল, জয়গোপাল সেন প্রভৃতি অনেক ভক্ত আসিলেন। মেয়ে ভক্তেরা অনেকেই আসিয়াছেন। তাঁহারা চিকের আড়ালে বসিয়া ঠাকুরের (Kathamrita) দর্শন করিতেছেন। মোহিনীর পরিবারও আসিয়াছেন— পুত্রশোকে উন্মাদের ন্যায়—তিনি ও তাঁহার ন্যায় সন্তপ্ত অনেকেই আসিয়াছেন, এই বিশ্বাস যে ঠাকুরের কাছে নিশ্চই শান্তিলাভ হইবে।

    আজ ১লা বৈশাখ, চৈত্র কৃষ্ণা ত্রয়োদশী, ১২ই এপ্রিল, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ, বেলা ৩টা হইবে।

    মাস্টার আসিয়া দেখিলেন, ঠাকুর (Ramakrishna) ভক্তের মজলিস করিয়া বসিয়া আছেন ও নিজের সাধনা বিবরণ ও নানাবিধ আধ্যাত্মিক অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন। মাস্টার আসিয়া ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন ও তাঁহার কাছে আসিয়া বসিলেন।

    শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি)—সে সময় (সাধনার সময়ে) ধ্যানে দেখতে পেতাম, সত্য সত্য একজন কাছে শূল হাতে করে বসে আছে। ভয় দেখাচ্ছে—যদি ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন না রাখি শূলের বাড়ি আমায় মারবে। ঠিক মন না হলে বুক যাবে।

    নিত্য-লীলাযোগ—পুরুষ-প্রকৃতি-বিবেকযোগ 

    “কখনও মা এমন অবস্থা করে দিতেন যে, নিত্য থেকে মন লীলায় নেমে আসত। আবার কখনও লীলা থেকে নিত্যে মন উঠে যেত।

    যখন লীলায় মন নেমে আসত কখনও সীতারামকে রাতদিন চিন্তা করতাম। আর সীতারামের রূপ সর্বদা দর্শন হত—রামলালকে (রামের অষ্টধাতু নির্মিত ছোট বিগ্রহ) নিয়ে সর্বদা বেড়াতাম, কখনও খাওয়াতাম। আবার কখনও রাধাকৃষ্ণের ভাবে থাকতাম। ওই রূপ সর্বদা দর্শন হত। আবার কখনও গৌরাঙ্গের ভাবে থাকতাম, দুই ভাবের মিলন—পুরুষ ও প্রকৃতি ভাবের মিলন। এ অবস্থায় সর্বদাই গৌরাঙ্গের রূপ দর্শন হত। আবার অবস্থা বদলে গেল! সজনে তুলসী সব এক বোধ হতে লাগল। ঈশ্বরীয় রূপ আর ভাল লাগল না। বললাম, ‘কিন্তু তোমাদের বিচ্ছেদ আছে।’ তখন তাদের তলায় রাখলাম। ঘরে যত ঈশ্বরীয় পট বা ছবি ছিল সব খুলে ফেললাম। কেবল সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দ সেই আদি পুরুষকে চিন্তা করতে লাগলাম। নিজে দাসীভাবে রইলুম—পুরুষের দাসী।

LinkedIn
Share