মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: তাঁর সুরে আজও ডুব দিলে মনের অলি-গলি খুশিতে ভরে ওঠে। তাঁর সুর যেন একমুঠো খুশির উপহার। তাঁর আওয়াজ বেদনার আশ্রয়। আজ ২৮ সেপ্টেম্বর। আজ দেশের অন্যতম সঙ্গীত শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের জন্মদিন। ভারতীয় সঙ্গীতে জনপ্রিয়তার নিরিখে সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী তিনি। বেঁচে থাকলে সুর সম্রাজ্ঞীর আজ ৯৫ বছর (জন্ম ১৯২৯) পুর্ণ হত। সঙ্গীত দুনিয়ায় এক বিস্ময়ের নাম লতা মঙ্গেশকর। সারা বিশ্বের ৩৬টি ভাষায় ৩০ হাজারের বেশি গান রেকর্ড করেছিলেন ‘নাইটিঙ্গল অফ ইন্ডিয়া’।
বাবাই প্রথম গুরু
মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে ১৯২৯ সালে জন্ম নেন লতা। বাবা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর মরাঠি বংশপরম্পরায় গোয়ার মঙ্গেশি গ্রামের পূজারি ব্রাহ্মণ, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষক এবং নাট্যব্যক্তিত্ব। মা শিবন্তী। জন্মের পরে স্বামী-স্ত্রী মেয়ের নাম রেখেছিলেন হেমা। পরে নাম বদলে রাখা হয় লতা। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বড় লতাই। সুর চেনার প্রাথমিক পর্বের পাঠ সঙ্গীতজ্ঞ বাবার কাছেই। পাঁচ বছর বয়সে দীননাথের নাটকে অভিনয় করেছিলেন। কিংবদন্তী এই গায়িকা সুরের জগতে পা রেখেছিলেন পাঁচের দশকের গোড়ার দিকে৷ সঙ্গীত জগতের অবিসংবাদী সম্রাজ্ঞী হওয়ার আগে শিশু অভিনেতা হিসেবেই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ শুরু করেছিলেন এই প্রবাদ প্রতিম শিল্পী । ১৯৪২ সালে একটি মারাঠি ছবির সৌজন্যে প্রথম গান রেকর্ড করেন তিনি।
প্লে-ব্যাকের দুনিয়ায় দীর্ঘ যাত্রাপথ
মাত্র ১৯ বছর বয়সে খ্যাতির মুখোমুখি হয়েছিলেন লতা মঞ্জেশকর। ১৯৪৮ সালের বম্বে টকিজের প্রযোজনায় তৈরি ‘মহল’-এর ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটিই তাঁকে প্রথম জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তারপর একে একে ‘বরসাত’, ‘বড়ি বহন’, ‘আন্দাজ’, ‘আনারকলি’, ‘আলবেলা’ ছবিতে প্লেব্যাক করে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছেন লতা। সেই স্থানেই বিরাজ করছেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে অনিল বিশ্বাস, শঙ্কর-জয়কিষণ, শচীন দেব বর্মণ, নৌশাদ আলি, সি রামচন্দ্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন, কল্যাণজি-আনন্দজি, সলিল চৌধুরীর মতো সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে যুগান্তকারী কাজ। ছয়ের দশকেও জয়যাত্রা অব্যাহত। ১৯৬০ সালে মুঘল-এ-আজম সিনেমায় মধুবালার ঠোঁটে লতার ‘প্যায়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’ নয়া ইতিহাস তৈরি করল।
সাতের দশকে যে সব গানকে লতাকণ্ঠ স্মরণীয় করে গিয়েছে, তার অধিকাংশই লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল এবং রাহুল দেব বর্মণের সঙ্গে। রাহুল দেব বর্মণের সুর করা প্রথম ও শেষ, দু’টি ছবির গানেই রয়েছে লতার কণ্ঠ। নয়ের দশকেও লতা পূর্ণপ্রভায় উপস্থিত। কাজ করেছেন আনন্দ-মিলিন্দ, যতীন-ললিত, অনু মালিক, উত্তম সিং থেকে এ আর রহমানের মতো সুরকারের সঙ্গে।
বাংলার সঙ্গে আত্মিক যোগ
বাংলা গানের ইতিহাসেও লতা মঙ্গেশকর এক চিরকালীন অধ্যায়। বাংলার প্রতি তাঁর টান একটু বেশিই ছিল। বার বার বলেছেন সে-কথা। লিখেও গিয়েছেন। মনে করতেন, মরাঠি আর বাংলার মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত মিল রয়েছে। বাংলার সঙ্গে একাত্ম বোধ করেছেন নানা ভাবে। তাঁর বাবার ঘরে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন লতা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রিয়তম লেখক। রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর পাথেয়। সুস্পষ্ট ও ঝরঝরে বাংলা উচ্চারণেই তিনি বলতেন— ‘বাংলা ভাষা খুব প্রিয়, কিন্তু শিখেও আমি বলতে পারি না!’ আমবাঙালি লতা মঙ্গেশকরের পরিজন হয়ে উঠেছে তাঁর বাংলা গানের মায়ায়। বাংলা গানের প্রচুর রেকর্ড করেছেন লতা। বাংলার বহু সুরকারের সুরে গেয়েছেন। পাশাপাশি গেয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের জন্যও। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘প্রেম এক বারই এসেছিল নীরবে’, সলিল চৌধুরীর কথা-সুরে ‘না যেও না’র মতো অবিস্মরণীয় সব বাংলা গান রেখে গিয়েছেন লতা। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে তাঁর গাওয়া ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে’ বাঙালির স্মৃতির গভীরে জেগে থাকা আকাশপ্রদীপই।
জীবনে নানা সম্মান
জীবনে বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। পেয়েছেন ‘ভারতরত্ন’, দাদাসাহেব ফালকে সম্মান, ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান লেজিয়ঁ দ’নর পুরস্কার। এ ছাড়া রয়েছে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসাবে তিন বার জাতীয় পুরস্কার। ১৯৯৯ সালে লতা রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন। তিনিই প্রথম ভারতীয় শিল্পী, যিনি রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে কনসার্ট করেছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে লতা ছিলেন সর্বোচ্চ স্থানে।
সত্তর বছর ধরে ভারতীয় সিনেমার অভিনেতা, নির্মাতা, সুরকার, এমনকি দর্শকও বদলেছে। থেকে গিয়েছে একমেবাদ্বিতীয়ম সেই কণ্ঠ। প্রতি প্রজন্মের নায়িকার থিম সং তাঁরই। নার্গিস থেকে ঐশ্বর্য, ‘পেয়ার হুয়া তো’ থেকে ‘হামকো হামিসে চুরালো’-র সুরে ভেসে গিয়েছে ভারত। মধুবালার ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’ থেকে কাজলের লিপে ‘তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সনম’, বৈজয়ন্তীমালার ‘হোঁটো মে অ্যায়সি বাত’ থেকে মাধুরীর ‘দিদি তেরা দেবর দিবানা’ পাগল হয়ছে আসমুদ্র হিমাচল। স্বাধীনতা দিবসে ঘুম ভাঙে লতার ‘অ্যায় মেরে বতন কে’ -এর সুরে। আবার তাঁর ‘দো ঘুঁট মুঝেভি’-তেই বুঁদ হয় ৩১ ডিসেম্বর বর্ষবরণের রাত। আসলে তাঁর আওয়াজই তাঁর পরিচয়, “চেহরা ইয়ে বদল যায়েগা। মেরি আওয়াজ হি পহেচান হ্যায়।”