মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: দেশের গণতন্ত্রের অন্ধকারতম সময়! ২৫ জুন, সালটা ১৯৭৫। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী (Indira Gandhi) ঘোষণা করলেন জরুরি অবস্থার (Emergency Period)। ১৯৭৭ সাল অবধি, ২১ মাস জারি থাকে এই জরুরি অবস্থা। সাংবিধানিক মূল্য়বোধের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে দেশে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল এই সময়। সরকারের বিরোধিতা, মানেই আশ্রয় হত অন্ধ কারাগার। সেই সময় সবচেয়ে সক্রিয় ও দক্ষ কর্মীদের জেলের বাইরে রেখে আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের নীতি। আরএসএস-এর সেই পরিকল্পনার অন্যতম মুখ ছিলেন তরুণ নরেন্দ্র মোদি (PM Narendra Modi)। গুজরাটের বিভিন্ন প্রান্তে—বরোদা, আমেদাবাদ, রাজকোটে ঘুরে ঘুরে তিনি মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করছিলেন জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে। পুলিশের চোখ এড়িয়ে আরএসএস-এর বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তিনি নানা রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন—কখনও ‘সর্দারজি’, কখনও ‘বটুকভাই’, তো কখনও ‘স্বামীজি’।
‘বটুকভাই’ থেকে ‘স্বামীজি’ – ছদ্মবেশের কাহিনী
১৯৭৫ সালের ২৫শে জুন থেকে ২১ মাসব্যাপী দেশে জারি হওয়া জরুরি অবস্থার সময়, সরকারের কড়া দমননীতি থেকে বাঁচতে নানা ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই সময় তাঁকে ‘বেশভূষার মাস্টার’ বলেও ডাকা হতো। জরুরি অবস্থার সময় আরএসএস-এর নীতি ছিল যে কোনও মূল্যে জেলের বাইরে থেকে অস্থির সময়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আরএসএস তখন কার্যত আন্ডারগ্রাউন্ডে। সেই সময় তৈরি করা হয়েছিল গুজরাট লোক সংঘর্ষ সমিতি। সেই সময় মাত্র ২৫ বছর বয়সে আরএসএসের সাধারণ সম্পাদক পদে উঠে এসেছিলেন মোদি। সেই সময় নানা লেখালেখি করতেন মোদি। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তাঁর সেই লেখা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই সময় যাতে চিহ্নিত না হয়ে যান সেকারণে নরেন্দ্র মোদি কখনও স্বামীজি, কখনও শিখের ছদ্মবেশ ধরতেন। তখনই গুজরাট ভ্রমণের সময় মোদি ‘বটুকভাই’ নাম নিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করেন। পরে এক পর্যায়ে, তিনি সন্ন্যাসীর বেশ নেন—গায়ে গেরুয়া বসন, মুখে ধর্মীয় ভাষ্য। একদিন, তিনি যে বাড়িতে ছিলেন, সেখানে স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়ের একজন আচার্য উপস্থিত হন। তখন পরিবারের লোকেরা তাঁকে ‘উদয়পুর থেকে আগত স্বামীজি’ বলে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর আচার্য ও ছদ্মবেশী ‘স্বামীজি’-র মধ্যে ধর্মীয় বিতর্কও শুরু হয়!
ভবনগর জেলে ‘সৎসঙ্গ’ করে বার্তা পৌঁছানো
জরুরী অবস্থা জারির পরেই মোদি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেই সময় তিনি ও তাঁর সতীর্থরা নানা ধরনের মিটিং করতেন কিছুটা আড়ালে। সিনিয়র আরএসএস নেতা নাথ জাগড়া, বসন্ত গজেন্দ্রগড়করের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি তথ্য় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কিছুটা অভিনব পথ নিয়েছিলেন। সাবধানে পরিকল্পনা করে, ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে মোদি ‘স্বামীজি’ ছদ্মবেশে ভবনগর জেলে পৌঁছান। সেখানে আটক আরএসএস নেতা বিশ্নুভাই পাণ্ড্যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। একটি ‘সৎসঙ্গ’-এর অজুহাতে তিনি জেলের ভিতরে প্রবেশ করেন এবং এক ঘণ্টা ধরে গোপনে আলোচনা করেন। পুলিশের চোখ এড়িয়ে নির্বিঘ্নে বেরিয়েও আসেন।
‘সর্দারজি’ সেজে কলেজ ছাত্রদের মাঝে
কংগ্রেসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেই সময় গুজরাটে ছাত্রদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে গুজরাটে শুরু হয়েছিল নবনির্মাণ আন্দোলন। সেই সময় দেখা গিয়েছিল পড়ুয়াদের শক্তি। সেই সময় আরএসএসের যুব প্রচারক ছিলেন মোদি। অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের আওতায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সেই সময় তিনি ছাত্রদের আন্দোলনকে সমর্থন করেন। তখন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ছদ্মবেশ ছিল ‘সর্দারজি’। মাথায় পাগড়ি পরে, শিখ বেশে তিনি ঘোরাফেরা করতেন। এমনকি কলেজপড়ুয়া ছাত্ররা তাঁর উপস্থিতিতে উচ্চস্বরে সর্দারজি-র কৌতুক বলতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। পরিচিত পরিবারের শিশু ও তাদের বন্ধুরাও এসে তাঁকে এই নতুন রূপে দেখতে পেত।
রহস্যময় এবং কৌশলী অধ্যায়
এই সব ছদ্মবেশ ও বুদ্ধিদীপ্ত চালচলনের জোরেই প্রশাসন তাঁর অবস্থান কখনও নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে পারেনি। প্রায়ই দেখা যেত, পুলিশ এসে পৌঁছানোর আগেই অন্য জায়গায় সরে গিয়েছেন মোদি। ১৯৭৭ সালে জরুরী অবস্থা উঠে যাওয়ার পরে নরেন্দ্র মোদি ক্রমেই জাতীয় ক্ষেত্রে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ছড়িয়ে দিতে থাকেন। আরএসএস-এর হাত ধরে ১৯৮৫ সালে বিজেপিতে যোগদান। তারপর ২০০১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীত্ব গ্রহণ। ২০১৪ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন মোদি। তারপর ভারতে আচ্ছে দিন-এর শুরু। কিন্তু আজও জরুরি অবস্থার অন্ধকার দিনে মোদির এই নানা ছদ্মবেশী কাহিনী তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক রহস্যময় এবং কৌশলী অধ্যায় হয়ে রয়ে গিয়েছে।
Leave a Reply