মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ব্রিটিশ শক্তির ভিত কেঁপে উঠেছিল সাঁওতাল বিদ্রোহে। এই আন্দোলনের (Santhal Rebellion) ধ্বনি ছিল ‘হুল’ (Hul Diwas), যার আক্ষরিক অর্থ বিদ্রোহ। ফি বছর ৩০ জুন পালিত হয় ‘হুল দিবস’। একই পরিবারের ছয় ভাইবোনের (সিধু, কানু, বিরসা, চাঁদ, ভৈরব, আর দুই বোন ফুলমণি এবং ঝানু মুর্মু ) নেতৃত্বে এই জনজাতি আন্দোলন শুধুমাত্র ভারত নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ এক দৃষ্টান্তও বটে। শাসকের শোষণ, অত্যাচার, বঞ্চনার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে অধিকার চাওয়ার এই সংগ্রাম আজও প্রেরণার স্রোত। সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। তার আগে ১৮৫৫ তে এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ ভারতের প্রথম সশস্ত্র সংগ্রাম বলে মনে করেন অনেক ঐতিহাসিক।
কেন অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন সহজ, সরল সাঁওতালরা?
সহজ, সরল জনজাতিদের জল-জঙ্গলের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে থাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (Hul Diwas)। ভূমির ওপর কর চাপায় তারা। যা আদায় করত কোম্পানির লেঠেল বাহিনী। এছাড়া সাঁওতাল রমণীদেরও খারাপ নজরে দেখা হত। যা কখনও মেনে নিতে পারেনি সাঁওতালরা। বঞ্চিত ক্ষোভ পূঞ্জীভূত হতে হতে তা বিদ্রোহের আকার নেয়। বর্তমান ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ জেলার ভাগনাদিহির মাঠে শুরু হয় জমায়েত। গবেষকদের মতে, আশপাশের চারশোর বেশি গ্রামের সাঁওতাল সেদিন জড়ো হয়েছিলেন অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে। সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ঐতিহাসিকদের মতে, সেদিন জমায়েত হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি জনজাতি সমাজের মানুষজন। শুধুমাত্র ইংরেজ নয়, পাশাপাশি স্থানীয় জমিদার ও মহাজনরাও সাঁওতালিদের ওপর জোর-জুলুম ও অত্যাচার চালাত। সেখানেই প্রাপ্য দাবি ছিনিয়ে নিতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন জনজাতির বীর সন্তানরা। এরপরেই শুরু হয় যুদ্ধ। বিদ্রোহের (Hul Diwas) থেকে যুদ্ধ বলাই ভালো। কারণ ব্রিটিশ সেনাকে সেদিন নামতে হয়েছিল বীর জনজাতিদের বিরুদ্ধে লড়তে। ‘হুল’ ‘হুল’ ধ্বনিতে সেদিন আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠেছিল বর্তমান ভারতের বিহার, ঝাড়খণ্ড, বাংলার পুরুলিয়া প্রভৃতি এলাকার।
ভাগনাদিহি থেকে কলকাতার অভিমুখে সশস্ত্র পদযাত্রা
সিধু-কানুর (Hul Diwas) নেতৃত্বে ভাগনাদিহি থেকে কলকাতার অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করে প্রায় ৩০ হাজার সাঁওতাল। পরবর্তীকালে দেশ অনেক গণপদযাত্রার সাক্ষী থেকেছে। কিন্তু আজ থেকে ১৬৮ বছর আগে অধিকারের দাবিতে এমন পদযাত্রা যে কোনও স্বাধীনতাকামী মানুষের মনকে নাড়া দেয়। ঐতিহাসিকদের মতে, পদযাত্রার সময় অত্যাচারী দারোগা মহেশাল দত্ত ছয়-সাতজন সাঁওতাল নেতাকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করে। এরপর ব্রিটিশ পুলিশ সিধু ও কানুকে গ্রেফতার করতে উদ্যত হলে বিক্ষুব্ধ সাঁওতাল বিপ্লবীরা ৭ জুলাই পাঁচকাঠিয়া নামক স্থানে মহাজন কেনারাম ভগত, মহেশাল দত্ত সহ ইংরেজ পক্ষের ১৯ জনকে হত্যা করেন এবং সেখানেই সাঁওতাল বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত হয়। গবেষকরা বলছেন, এরপর টানা আট মাস ধরে চলে সাঁওতাল বিদ্রোহ। দাপট, শৌর্য, বীরত্বে তখন ওই অঞ্চলগুলিতে শেষ হয় ব্রিটিশ আধিপত্য। ২১ জুলাই কাতনা গ্রামে ইংরেজ বাহিনী বিপ্লবীদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে। রণে ভঙ্গ দেয় ব্রিটিশরা।
বীরভূম জেলার তৎকালীন জনপদ নাগপুর বাজার ধ্বংস করে বিদ্রোহীরা
জুলাই মাসেই বীরভূম জেলার (Santhal Rebellion) তৎকালীন জনপদ নাগপুর বাজার ধ্বংস করে বিদ্রোহীরা। অভিযোগ, সেখানে সাঁওতাল জনগণকে ন্যায্যমূল্যে পণ্য দেওয়ার পরিবর্তে অত্যাচার করা হত। ১৮৫৫ সালের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিধু-কানুর বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার ‘অস্বা সামরিক আইন’ (অস্ত্রশস্ত্র বহনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা) জারি করে। কিন্তু আন্দোলনের সামনে এখানেও পিছু হঠতে হয় ব্রিটিশদের। ১৮৫৬ সালের ৩ জানুয়ারি সামরিক আইন প্রত্যাহার করে তারা। বিদ্রোহের অন্যতম বীরাঙ্গনা ফুলমণি মুর্মুকে ব্রিটিশ সেপাইরা নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করে তাঁর লাশ রেললাইনে ফেলে রেখে যায়, এমনটাই মত কোনও কোনও গবেষকদের। আজও এই বীরাঙ্গনা জনজাতি সমাজে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
ফাঁসির মঞ্চে কানুর ঘোষণা
ইংরেজ আমলে স্থানীয় মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের শোষণ ও নিপীড়ন এবং ব্রিটিশদের অত্যাচারের শিকার হয়ে তা থেকে মুক্তির লক্ষ্যেই এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস ভঙ্গ করেন কয়েকজন। ব্যক্তিস্বার্থে ভেসে গিয়ে ইংরেজদের ফাঁদে পা দেন কয়েকজন সাঁওতাল। ব্যর্থ হয় বিপ্লব। ব্রিটিশের হাতে গ্রেফতার হন সিধু। পরে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে ১৮৫৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ভগনডিহির সন্নিকটে পাঁচকাঠিয়া বটবৃক্ষে ফাঁসির মঞ্চে তোলা হয় কানুকে। ফাঁসির মঞ্চ থেকে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “আমি আবার আসব, আবার সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলব।” ব্যর্থ হলেও পরোক্ষে সাঁওতাল বিদ্রোহই সিপাহী বিদ্রোহের ভিত গড়ে দেয়। অত্যাচারিত মানুষ বুঝতে পারে লড়াই করে বড় শক্তিকেও নাড়িয়ে দেওয়া যায়। অধিকার চাইলে পাওয়া যায় না, ছিনিয়ে নিতে হয়।
Leave a Reply