মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: হেডিংলি টেস্টের চতুর্থ দিনে এক অনন্য ব্যাটিং মহাকাব্যের সাক্ষী থাকল ক্রিকেট বিশ্ব। ভিন্ন মেজাজের দুই ব্যাটার—কেএল রাহুল ও ঋষভ পন্থ, লিখলেন ইতিহাস। ১৯৫ রানের দুর্দান্ত পার্টনারশিপ, ভারতকে নিয়ে গেল শক্তপোক্ত অবস্থানে। একদিকে বরফের মতো ঠান্ডা মাথার রাহুল অন্যদিকে, আগুনের মতো তেজী পন্থ। একদিক, দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটার রাহুল অন্যদিকে, পন্থের ব্যাটিং কখনোই প্রথাগত টেস্ট ক্রিকেটের ছাঁচে ফেলা যায় না। এই দুই চরম ভিন্ন স্বভাবের ব্যাটার মিলে গড়ে তুললেন ‘আ সং অফ আইস অ্যান্ড ফায়ার’-এর মতো এক অনবদ্য কাহিনি—ঠিক যেন জর্জ আর আর মার্টিনের কাল্পনিক রাজ্য ওয়েস্টেরস-এর দুই ত্রাতা মিলে এক নতুন রাজাকে সিংহাসনে বসাতে যুদ্ধ করছে।
নতুন রাজার জন্য নয়া যোদ্ধা
শুভমান গিলের নেতৃত্বে লাল বলের ক্রিকেটে ভারতের ‘নতুন যুগের সূচনা’ করলেন রাহুল-পন্থ। শুরুর দিকে পন্থ নিজের স্টাইলে দ্বিতীয় বলেই ডাউন দ্য ট্র্যাকে এসে বাউন্ডারি হাঁকালেন। আর রাহুল খেললেন টেস্ট বইয়ের আদর্শ উদাহরণ—আউটসাইড অফ স্টাম্পে বল হলে ব্যাট লুকিয়ে রাখলেন, শৃঙ্খলা বজায় রাখলেন। তবে পন্থের আগ্রাসন ছিল একেবারে নিখুঁত পরিকল্পনার ফল। স্টোকস-কার্সের অসাধারণ স্পেলের মাঝেও তিনি ধৈর্য ধরলেন, কিন্তু যখন সময় এলো, তখন ছুটে বেরোলেন যেন আগুনের ড্রাগন। ওয়েস্টেরসের যোদ্ধাদের মতোই ইংল্যান্ডের প্রতিরোধকে ছিন্ন করে দিলেন ব্যাট হাতে। চেতেশ্বর পূজারা তাদের ইনিংসের প্রশংসা করে বললেন, “প্রথম সেশনটা খুব কঠিন ছিল। ইংল্যান্ডের বোলাররা দারুণ বল করছিল—বিশেষ করে ব্রাইডন কার্স। কিন্তু রাহুল আর পন্থ সেই সময়টা সামলে নিল খুবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে।” তিনি আরও যোগ করেন, “ঋষভকে বেশিক্ষণ চুপ করিয়ে রাখা যায় না, এটা আমি জানি। কিন্তু আজ সে দারুণ সময়জ্ঞান দেখিয়ে আগ্রাসন চালিয়েছে। রাহুল সবসময়ের মতো ধৈর্য দেখিয়েছে, আর পন্থ সেটা মেনেই এগিয়েছে।”
ভিন্ন দুই চরিত্রের মিশেল
রাহুলের সৌন্দর্য্যপূর্ণ ড্রাইভ আর পন্থের হঠাৎ বিস্ফোরণের এই মিশেলই ভারতীয় ব্যাটিংকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল। তাঁরা যেন নাইটস ওয়াচের রেঞ্জার হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ইংল্যান্ডের ‘উইন্টার’ মোকাবিলায়। এখনও সিরিজের অনেকটা বাকি, আরও আটটি ইনিংস পড়ে আছে। কিন্তু এই জুটি যে এক রাজ্য রক্ষার প্রতিজ্ঞা নিয়েছে, তা হেডিংলির যুদ্ধেই প্রমাণ হয়ে গেল। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা—শুভমন গিলের রাজত্বে আরও কতবার এই দুই ‘যোদ্ধা’ ব্যাট হাতে অস্ত্র তুলে নেবে, সেটাই দেখার। ম্যাচটা ভারতের দিকে ঝুঁকেছিল তৃতীয় দিনের শেষেই। প্রথম ইনিংসে তিনটে সেঞ্চুরির পর দ্বিতীয় ইনিংসটাও ছিল ব্যাটারদের। শুরুটা করেন কেএল রাহুল। ২০২ বলে তিনি সেঞ্চুরি করেন। এরপর পন্থের সেঞ্চুরি ছিল সময়ের অপেক্ষা, রাহুলের সেঞ্চুরির পরে পন্থ সেঞ্চুরি পেলেন। চলতি টেস্টে জোড়া সেঞ্চুরি করলেন তিনি। ১৩০ বলে সেঞ্চুরি পেলেন পন্থ। সঙ্গে প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইংল্যান্ডের মাটিতে এক ম্যাচে পরপর দুটো সেঞ্চুরি করলেন পন্থ। সঙ্গে রেকর্ডবুকে নাম লিখিয়ে ফেললেন।
পন্থের রেকর্ড
আইপিএলে তাঁকে নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। তবে ইংল্যান্ডে গিয়ে সমালোচনার জবাব গুনে গুনে দিচ্ছেন ঋষভ পন্থ। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও শতরান করলেন তিনি। একাধিক নজির তৈরি করলেন ভারতীয় উইকেটকিপার হিসেবে। বিশ্বের দ্বিতীয় উইকেটকিপার হিসেবে দুই ইনিংসেই শতরান করার নজির গড়লেন পন্থ। ২০০১ সালে হারারেতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে জ়িম্বাবোয়ের অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ১৪২ এবং অপরাজিত ১৯৯ করেছিলেন। পন্থ ১৩৪ এবং ১১৮ রান করলেন। বিশ্বের প্রথম উইকেটকিপার হিসেবে ইংল্যান্ডে একই টেস্টে জোড়া শতরান করলেন তিনি। এক টেস্টে জোড়া শতরানের নজির রয়েছে অনেক ভারতীয়েরই। বিজয় হজারে প্রথম এই নজির গড়েন। ১৯৪৮ সালে অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দুই ইনিংসেই শতরান করেছিলেন। যদিও ম্যাচটি হেরেছিল ভারত। এর পর এই নজির গড়েন সুনীল গাভাস্কর। তিন বার একই টেস্টে জোড়া শতরান করেছেন তিনি। দু’বার এই কীর্তি রয়েছে রাহুল দ্রাবিড়ের। এক বার করে এই নজির গড়েছেন বিরাট কোহলি, অজিঙ্ক রাহানে, রোহিত শর্মা। সোমবার পন্থ সেই তালিকায় ঢুকে পড়লেন। এ ছাড়া, একটি টেস্টে ন’টি ছক্কা মারলেন পন্থ। এই কীর্তি রয়েছে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ (২০০৫, বনাম অস্ট্রেলিয়া) এবং বেন স্টোকসের (২০২৩, বনাম অস্ট্রেলিয়া)।
রেকর্ড-বুকে রাহুল
লিডসে প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে শতরান করেছেন কেএল রাহুল। প্রথম ইনিংসে ভাল খেললেও ৪২ রানের বেশি করতে পারেননি। দ্বিতীয় ইনিংসে অভাব মিটিয়ে দিলেন তিনি। ১৮ মাস পর শতরান এল টেস্টে। নজিরও গড়েছেন ভারতের ক্রিকেটার। প্রথম ভারতীয় ওপেনার হিসাবে ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনটি শতরান করলেন তিনি। ইংল্যান্ডের মাটিতে ১৮টি ইনিংস খেলে তিন নম্বর শতরান করেছেন রাহুল। তার আগে রাহুল দ্রাবিড়, সুনীল গাওস্কর, বিজয় মার্চেন্ট এবং রবি শাস্ত্রীর দু’টি করে শতরান ছিল। টেস্টে এই নিয়ে নবম শতরান হল রাহুলের। আগেও ইংল্যান্ডে দু’টি শতরান রয়েছে তাঁর। তাঁর ১৩৭ রানের ইনিংসের গুরুত্বও কম নয়। ওপেন করতে নেমে ৮৫তম ওভার পর্যন্ত ২২ গজের এক প্রান্ত আগলে রাখলেন। দলকে নির্ভরতা দিলেন। যতটা সম্ভব ঝুঁকিহীন থাকার চেষ্টা করেছেন। দলের অভিজ্ঞতম ব্যাটারের ভূমিকা যেমন হওয়া উচিত, ঠিক সেটাই করেছেন। ২৪৭ বলের ইনিংসে নিজে রান তোলার গতি বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি পন্থকে সামলে রেখেছেন। দায়িত্বশীল রাহুল সম্পদ হয়ে উঠতে পারেন বিরাট কোহলি-রোহিত শর্মাহীন ভারতীয় শিবিরের। চতুর্থ উইকেটে তাঁদের ১৯৫ রানের জুটি একটা সময় দিশেহারা করে তুলেছিল বেন স্টোকসদের।
Leave a Reply