মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: গত সপ্তাহেই ভারত সরকারের থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে ইলন মাস্কের ইন্টারনেট পরিষেবা সংস্থা স্টারলিঙ্ক। গত ৬ জুন টেলিকম মন্ত্রকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় লাইসেন্স পেয়েছে স্টারলিঙ্ক। এর ফলে ভারতে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করতে পারবে সংস্থাটি। এর পর থেকেই স্টারলিঙ্কের পরিষেবা পেতে কত খরচ হতে পারে, সেই নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছিল। অবশেষে, সোমবার, প্রকাশ্যে এল সেই অঙ্ক।
সেট-আপ করলেই প্রথম মাস ফ্রি!
সংবাদসংস্থা এএনআই-র একটি প্রতিবেদন তরফে জানা গিয়েছে, ভারতে প্রতি বাড়িতে স্টারলিঙ্কের বিশেষ যন্ত্র বসাতে খরচ পড়বে ৩৩ হাজার টাকা। আর মাসে মাসে এই পরিষেবা পাওয়ার জন্য দিতে হবে ৩ হাজার টাকা। তবে, গ্রাহকদের আকর্ষিত করতে বিশেষ অফার নিয়ে এসেছে সংস্থাটি। জানা গিয়েছে, প্রথম মাসের সাবস্ক্রিপশন মকুব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইলনের সংস্থা। অর্থাৎ, সেটআপ করার জন্য ৩৩ হাজার টাকা দিলেই প্রথম এক মাস নিখরচায় ইন্টারনেট পরিষেবা পেতে পারেন গ্রাহক। দ্বিতীয় মাস থেকে মাসিক ৩ হাজার টাকা করে দিতে হবে।
খরচ বনাম সুবিধে!
বর্তমান পরিষেবা পেতে একজন ব্যবহারকারীকে যত খরচ করতে হয়, স্টারলিঙ্কে সেই পরিমাণ অনেকটাই বেশি। এত টাকা দিয়ে ইন্টারনেট বসানো অনেকের কাছে বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে। ফলে, স্টারলিঙ্ক কতটা সাফল্য পাবে তা সময়ই বলবে। তবে, স্টারলিঙ্ক আশাবাদী। সংস্থার দাবি, যেহেতু তাদের পরিষেবা সরাসরি উপগ্রহ-মারফৎ হবে, তাই ইন্টারনেটের স্পিড (যা গ্রাহককূল মূল বিচার করে থাকে) অন্যের তুলনায় অনেকটাই বেশি হবে। উপরন্তু, একবারে প্রত্যন্ত জায়গাতেও এই পরিষেবা অনায়াসেই মিলবে। ফলে, আখেরে লাভবান হবেন ব্যবহারকারীরাই। এক নজরে দেখে নেওয় যাক, স্টারলিঙ্ক কী এবং তা কীভাবে কাজ করে।
স্টারলিঙ্ক কী?
স্টারলিঙ্ক প্রচলিত ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী ব্যবস্থা নয়। এটি হল সরাসরি স্যাটেলাইট বা উপগ্রহ-ভিত্তিক ব্রডব্যান্ড পরিষেবা। অনেকটা ডিটিএইচ (ডায়রেক্ট-টু-হোম) পরিষেবার মতো। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট এমন একটি প্রযুক্তি যেখানে উপগ্রহের (Satellite) মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করা হয়। সাধারণত এটি সেই সমস্ত এলাকায় ব্যবহৃত হয়, যেখানে মোবাইল টাওয়ার বা ব্রডব্যান্ড পরিষেবা পৌঁছায় না— যেমন প্রত্যন্ত গ্রাম, পাহাড়ি অঞ্চল, দ্বীপ বা সাগরপারের অঞ্চল।
কীভাবে কাজ করবে স্টারলিঙ্ক?
এই পরিষেবায় একটি স্যাটেলাইট ডিশ এবং একটি মোডেম বা রাউটার ব্যবহার করা হয়। ব্যবহারকারী কোনও অনুরোধ পাঠালে (যেমন— একটি ওয়েবসাইট খোলা), সেই অনুরোধ প্রথমে স্যাটেলাইট ডিশ থেকে উপগ্রহে যায়। উপগ্রহ সেটি গ্রাউন্ড স্টেশনে (NOC) পাঠায়, যেখানে থেকে তথ্য প্রক্রিয়া করে আবার সিগন্যালের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর ডিভাইসে পাঠিয়ে দেয়। স্টারলঙ্ক ব্যবস্থায় একজন উপভোক্তা ৫০ থেকে ২৫০ এমবিপিএস পর্যন্ত উচ্চ-গতির ইন্টারনেট পরিষেবা পাবেন।
স্টারলিঙ্কের কেন্দ্রে উপগ্রহ-পুঞ্জ
স্টারলিঙ্ক ব্যবস্থায় পৃথিবীর লো-আর্থ অরবিটে (ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫০০ থেকে ২০০০ কিলোমিটার উচ্চতায়) প্রদক্ষিণকারী ছোট উপগ্রহের একটি সমষ্টি থেকে সরাসরি ইন্টারনেট বিম করে ফাইবার অপটিক্স এবং সেলুলার টাওয়ারের সীমারেখাকে অতিক্রম করতে পারবে। এই স্যাটেলাইটগুলি ব্যবহারকারীর বাড়িতে বা অফিসে স্থাপিত একটি কমপ্যাক্ট ডিশ অ্যান্টেনার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, যা পরে রাউটারের বা মোডেমের মাধ্যমে ইন্টারনেট রিলে করে। বর্তমানে, ৬ হাজারেরও বেশি উপগ্রহ ইতিমধ্যেই কক্ষপথে রয়েছে এবং ২০২৭ সালের মধ্যে নেটওয়ার্ক ৪২ হাজার উপগ্রহপুঞ্জ তৈরি করা হবে। এই সম্প্রসারণের জন্য একটি রোডম্যাপও রয়েছে বলে সংস্থা জানিয়েছে।
ভারতে কেন গুরুত্বপূর্ণ স্যাটেলাইট-ইন্টারনেট?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের বহু গ্রামীণ বা দুর্গম অঞ্চলে এখনও ইন্টারনেট পৌঁছায়নি। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেই সমস্ত জায়গায় দ্রুত ও স্থায়ী ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। বিশেষত স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা কৃষি সংক্রান্ত উন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। স্টারলিঙ্ক মূলত ভারতের এমন সব এলাকায় পরিষেবা দিতে চায়, যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক বা ফাইবার অপটিক কভারেজ নেই বা খুবই দুর্বল। তবে, খরচের বিষয়টাই যা বাধা হতে পারে। কারণ, ভারত যে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সস্তা মোবাইল ডেটা ব্যবহারের দেশ, তা কারও অজানা নয়। ফলে, স্টারলিঙ্ক নিলে সেই খরচ এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে। যদিও, স্টারলিঙ্কের ভরসা হতে পারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্রুতগতি ও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট পরিষেবার সুবিধা।
কবে থেকে চালু হবে পরিষেবা?
লাইসেন্স হাতে পেলেও স্টারলিঙ্কের পথ এখনও পুরোপুরি মসৃণ নয়। ভারতের টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি (TRAI) এখনও স্যাটেলাইট স্পেকট্রাম বরাদ্দ সংক্রান্ত সুপারিশের অনুমোদন পায়নি। এটি অনুমোদিত হলেই পূর্ণমাত্রায় পরিষেবা চালু করতে পারবে স্টারলিঙ্ক। ফলে, পরিষেবা চালু হতে হতে আরও এক বছর লাগতে পারে। ইতিমধ্যে, এশিয়ার একাধিক দেশে ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে স্টারলিঙ্ক পরিষেবা—জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, ভুটান ও বাংলাদেশ। সেখানে মাসিক খরচ ২,৬০০ টাকা থেকে ৬,০০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে।
স্টারলিঙ্কের প্রতিযোগী কারা?
এই ময়দানে স্টারলিঙ্কের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হল রিলায়েন্স জিও স্যাটেলাইট এবং ভারতী এয়ারটেল-এর ওয়ানওয়েব। মাস্কের সংস্থার সঙ্গে এই দুই সংস্থাকেও স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদান করার অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্র। তবে, এই তিন সংস্থা নিজেদের পরিষেবা শুরু করলেও, একে অপরের সহায়ক হিসেবেও কাজ করবে। এর জন্য গতমাসে ভারতের টেলিকম অপারেটর সংস্থা রিলায়েন্স জিও এবং ভারতী এয়ারটেলের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে স্টারলিঙ্ক। ভারতে এই দুই সংস্থার ইতিমধ্যেই বিপুল বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে। ভারতের বেশিরভাগ জায়গাতেই এই সংস্থাগুলির নেটওয়ার্ক রয়েছে। এই দুই সংস্থার অনলাইন ও অফলাইন স্টোরের মাধ্যমে এবার থেকে স্টারলিঙ্ক ইকুইপমেন্ট বিক্রি করতে পারবে। উল্টোদিকে, এয়ারটেল পরিকল্পনা করছে যাতে তাদের নেটওয়ার্কের মধ্যেই স্টারলিঙ্ক ইন্ট্রিগ্রেট করা যায়। রিলায়েন্স জিও সংস্থা তার ব্রডব্যান্ড সিস্টেমে এই স্টারলিঙ্ক অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
স্যাটেলাইট-ইন্টারনেটের দুর্বলতা
খরচ ছাড়াও স্টারলিঙ্কের মতো স্যাটেলাইট-ইন্টারনেটের বেশ কিছু দুর্বলতাও রয়েছে। প্রথমত, গ্রাহক সংখ্যা বেশি হলে, তা পরোক্ষভাবে ইন্টারনেট স্পিডকে প্রভাবিত করতে পারে। ফলত, গতি কমে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, যোগাযোগ যেহেতু সরাসরি স্যাটেলাইট নির্ভর, তাই পরিষ্কার আকাশ হওয়া বাধ্যতামূলক। এদেশে, প্রায়ই ঝড়-জল-বৃষ্টি-মেঘ থাকে। তেমন হলে, স্যাটেলাইটের সঙ্গে ডিশের যোগাযোগে বিঘ্ন হতে পারে। ঠিক যেমনটা হয় ডিটিএইচ-এর ক্ষেত্রে। তৃতীয়ত, ডিশ চৌম্বকীয় হওয়ায়, বজ্রপাতের সময় সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক।
Leave a Reply