মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: জম্মু–কাশ্মীরসহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের নিরাপত্তা সংস্থাগুলি গত ২০ বছরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করা কাশ্মীরি শিক্ষার্থীদের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে। সম্প্রতি “হোয়াইট কলার” সন্ত্রাস মডিউলে (White Collar Terror Module) উচ্চশিক্ষিতদের জড়িত থাকার তথ্য সামনে আসতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই চিকিৎসক। উল্লেখ্য, ২০০০ সালের শুরুর দিকে শত শত কাশ্মীরি ছাত্র চিকিৎসাশিক্ষার জন্য পাকিস্তানে যান। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অনেকেই বাংলাদেশকে গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, এই পুরো গোষ্ঠীর বিভিন্ন আর্থিক লেনদেন, যাতায়াতের ইতিহাস ও সীমান্ত–পার যোগাযোগ এখন খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
সন্ত্রাসে অর্থসাহায্য নিয়ে উদ্বেগ
ইতিহাস বলছে, পাকিস্তান–ভিত্তিক কিছু সংগঠন চিকিৎসাশিক্ষার জন্য কাশ্মীরি ছাত্রদের সাহায্য করত। মেধাবী-প্রতিভাবান তরুণদের পাকিস্তানে ডাক্তারি পড়তে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিত, এই সংগঠনগুলি। প্রসঙ্গত, ওই ছাত্রদের ভর্তি কার্যক্রমে সহায়তা করত যে সংগঠনগুলি, তাদের পরে সন্ত্রাসে অর্থসাহায্যের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা গিয়েছে। অভিযোগ, কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খরচ অবৈধভাবে চালানো হত। পরে তাদের মগজধোলাই করে সন্ত্রাস সৃষ্টিতে ব্যবহার করা হত। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা অনেক চিকিৎসক ভারতে ডিগ্রি স্বীকৃতি ও বাধ্যতামূলক স্ক্রিনিং পরীক্ষায় সমস্যায় পড়েন। নিরাপত্তা সংস্থাগুলির দাবি, খুব কম সংখ্যক ব্যক্তি লস্কর-ই-তৈবা বা হিজবুল মুজাহিদিনের মতো সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। অধিকাংশই সাধারণভাবে চিকিৎসা পরিষেবায় যুক্ত হন বা বিদেশে চলে যান। তা সত্ত্বেও, যাদের ভ্রমণ, অর্থের উৎস বা যোগাযোগের ধরন সন্দেহজনক, তাদের ওপর বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ জনপ্রিয় বিকল্পে পরিণত
পাকিস্তানে শিক্ষিত চিকিৎসকদের ওপর নজরদারি বাড়ায় গত এক দশকে বহু কাশ্মীরি ছাত্র বাংলাদেশে চিকিৎসাশিক্ষায় ভর্তি হন। ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজে তারা তুলনামূলক কম খরচে ও নিশ্চিত ভর্তির সুযোগে আকৃষ্ট হন। যদিও বাংলাদেশকে এক বছর আগেও ভারতে নিরাপত্তার ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে দেখা হত না। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ ভারতের বন্ধু হিসেবেই পরিচিত ছিল। গত বছর হাসিনা পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা বাড়ে। তদন্তকারীরা বলছেন—কিছু ক্ষেত্রে কাশ্মীর থেকে পাকিস্তান বা বাংলাদেশে ডাক্তারিতে ছাত্র ভর্তির জন্য এজেন্টরা পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সমান্তরালভাবে কাজ করেছিল। এক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের পরিষ্কার ব্যাখ্যাও মেলেনি।
পাকিস্তানে বারবার ভ্রমণ
কিছু শিক্ষার্থীর পাকিস্তান কিংবা উপসাগরীয় দেশে অযৌক্তিক ভ্রমণও প্রশ্ন তুলেছে গোয়েন্দা মহলে। সম্প্রতি কয়েকজন চিকিৎসকের “হোয়াইট কলার” সন্ত্রাস চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারের পর তদন্ত আরও জোরদার হয়েছে। এই মডিউলে সমাজে পরিচিত, শিক্ষিত মানুষদের ব্যবহার করে অর্থ ও বার্তা আদান–প্রদান এবং লজিস্টিক সহায়তার কাজ করা হত বলে তদন্তকারীদের দাবি। বিদেশে চিকিৎসাশিক্ষার সঙ্গে অর্থের উৎস, ভর্তির প্রক্রিয়া ও সম্ভাব্য অপব্যবহারের সংযোগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছে তদন্তকারী আধিকারিকরা।
বিদ্যা-বুদ্ধি থাকার পরও কেন সন্ত্রাসের পথে
দিল্লির লালকেল্লার অদূরে বিস্ফোরণকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে হরিয়ানার আল-ফালাহ্ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক চিকিৎসককে গ্রেফতার করেছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। টানা জিজ্ঞাসাবাদের পর অবশেষে তাঁদের মধ্যে নির্দোষদের মুক্তিও দিল এনআইএ। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, দিল্লি বিস্ফোরণের সঙ্গে তাঁদের কোনও নির্দিষ্ট যোগসূত্র পাওয়া যায়নি। সাধারণ মানুষের কাছে ঈশ্বরের সমান, চিকিৎসকদের অগ্রভাগে রেখে দেশে যে সন্ত্রাসের জাল বোনা হয়েছিল, তাকে ‘হোয়াইট কলার টেরর মডিউল’ বলে উল্লেখ করছেন তদন্তকারীরা। চিকিৎসকদের ‘ভগবান’ বলা হয়, কারণ তাদের হাতে নির্ভর করে জীবন-মৃত্যু। কারোর জীবনে যেখানে ‘ঈশ্বর’ হয়ে ওঠেন কোনও চিকিৎসক, সেখানেই আজ চিকিৎসকই ‘শয়তান’! কারণ দিল্লিতে লালকেল্লার কাছে ১০ নভেম্বর যে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়, তার পিছনে হাত ছিল চিকিৎসকদেরই। বিস্ফোরণের সময় গাড়িতে ছিলেন ডঃ উমর। বিস্ফোরক উদ্ধার হয় আরেক চিকিৎসক, মুজাম্মিলের ভাড়া নেওয়া বাড়ি থেকে। নাম উঠে এসেছে ডঃ শাহিন নামক আরেক মহিলা চিকিৎসকের, যিনি ভারতে জইশের (Jaish-e-Muhammad) মহিলা শাখার প্রধান। দিল্লির এই বিস্ফোরণ চোখ খুলে দিয়েছে গোয়েন্দাদের যে সন্ত্রাস শুধুমাত্র সমাজের নিম্নস্তরের বা গরিব যুবদের মগজ ধোলাই করেই চালানো হয় না, বরং অতি উচ্চ-শিক্ষিতরাও সন্ত্রাসে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত দিচ্ছেন।
শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ ডাটাবেস তৈরি করে তদন্ত
জম্মু–কাশ্মীর পুলিশ, এনআইএ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এখন ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে পাকিস্তানে এবং ২০১০ সালের পর বাংলাদেশে চিকিৎসাশিক্ষা নিতে যাওয়া সব কাশ্মীরি শিক্ষার্থীর পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেস তৈরি করছে। তাদের শিক্ষার অর্থায়ন কীভাবে হয়েছে, ভর্তি করাতে কে সাহায্য করেছে, পরিবারের সঙ্গে সীমান্তের ওপারে কোনও সংযোগ ছিল কিনা, দেশে ফিরে তারা কী ধরনের কাজ করছেন—এসবই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যাদের অস্বীকৃত ক্লিনিক চালানো বা বারবার স্ক্রিনিং পরীক্ষায় ব্যর্থতার মতো তথ্য রয়েছে, তাদের নাম বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আগামী দিনে এ বিষয়ে আরও তদন্ত করা হবে, বলে জানানো হয়েছে। ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট অঞ্চলে মেডিক্যাল ভর্তি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আরও কঠোর যাচাইয়ের প্রয়োজন হবে কিনা, সেটিও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।

Leave a Reply